দিনে দেড় লাখ টাকা ঢোকে ইজারাদারের পকেটে, তবু সন্দ্বীপ ঘাটে চলছে ভাড়ার জুলুম

অকটেনে চলা স্পিডবোটের ভাড়া বাড়লো ডিজেলের অজুহাতে

প্রতিদিন লাখ টাকা আয় হচ্ছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা-গুপ্তছড়া ফেরিঘাটে। অথচ ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে ওই ঘাটের ইজারাদার হাজার হাজার মানুষের সন্দ্বীপ যাতায়াতের বাহন স্পিডবোটের ভাড়া একলাফে বাড়িয়ে দিয়েছে ২০ শতাংশ। এতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সন্দ্বীপ পারাপারে ফেরিঘাটে আসা যাত্রীরা। যাত্রীরা বলছেন, স্পিডবোটের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয় অকটেন। তাহলে ডিজেলের মূল্য বাড়লে কেন স্পিডবোটের ভাড়া বাড়ানো হবে? সন্দ্বীপের বাসিন্দাদের অভিযোগ, ঘাটের মানুষের দুর্ভোগকে পুঁজি করে ইজারাদার স্বেচ্ছাচারী আচরণ করছেন।

গত মঙ্গলবার (১ ফেব্রুয়ারি) থেকে কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই যাত্রী পারাপারে ২০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা-গুপ্তছড়া ফেরিঘাটের ইজারাদার। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে এভাবে একলাফে ২০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সন্দ্বীপবাসীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

ইজারাদারের এভাবে ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি জানে না ফেরিঘাট ইজারা দেওয়া চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষও (বিআইডব্লিউটিএ)।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌ ঘাটে প্রতিদিন সন্দ্বীপের তিন থেকে চার হাজার যাত্রী পারাপার করে। তার মধ্যে গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার যাত্রী স্পিডবোটে যাতায়াত করে থাকে।

ঘাটের কর্মী ও স্পিডবোট চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বড় স্পিডবোট একবার কুমিরা থেকে গুপ্তছড়া ঘাটে পৌঁছাতে প্রায় ২০ লিটার অকটেন প্রয়োজন হয়। এতে জ্বালানি খরচ পড়ে প্রায় ১৮০০ টাকা। এ হিসেবে ২৫০ টাকা জনপ্রতি ভাড়া হলে একটি স্পিডবোট থেকে আসে পাঁচ হাজার টাকা। জ্বালানি খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বোটে ৩২০০ টাকা ইজারাদারের পকেটে যায়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ বোট যাত্রী পারাপার করে থাকে। প্রতিদিন ১০০টি স্পিডবোট যাত্রী নিয়ে পারাপার করলে ঘাট ইজারাদার শুধুমাত্র স্পিডবোট থেকেই তিন লাখ ২০ হাজার টাকা আয় করছে। মোট এই আয় থেকে প্রতিদিন ৯০ হাজার টাকা জেলা পরিষদ এবং ঘাটের কর্মী, স্পিডবোট চালক, ঘাট পরিচালনা ব্যয়সহ অন্যান্য খাতে সবমিলিয়ে প্রতিদিন ৮০ হাজার টাকা খরচ ধরলেও মালবাহী ট্রলার ও যাত্রীবাহী ট্রলারের আয় ছাড়া শুধুমাত্র স্পিডবোট থেকেই প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ টাকা ইজারাদারের আয় থাকে এই ঘাট থেকে।

যাত্রীরা জানিয়েছেন, আগে যেখানে জনপ্রতি ২৫০ টাকা নেওয়া হতো, এখন সেখানে নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। এ ছাড়া মালামাল পারাপারেও নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া।

বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) গুপ্তছড়া-কুমিরা ফেরীঘাটের ভাড়া বাড়ানোর বিষয় নিয়ে সন্দ্বীপ প্রেস ক্লাবে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে এসে ঘাট ইজারাদার চেয়ারম্যান এসএম আনোয়ার হোসেন জানান, জ্বালানি তেল ও স্পিডবোট যন্ত্রাংশের দাম বৃদ্ধি এবং গত নভেম্বর থেকে নৌপরিবহনে সরকারিভাবে ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় ঘাটেও ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তবে তিনি ভাড়া বাড়ানোর আগে যাত্রীদের অবহিত না করার বিষয়টি সঠিক ছিল না বলেও মন্তব্য করেছেন।

দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ যাত্রীরা যেখানে ভাড়া কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে, সেখানে উল্টো ভাড়া বৃদ্ধির খামখেয়ালিপনা কেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে ইজারাদার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘২০১৩ সালে আমি যখন ঘাটের দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন জেলা পরিষদকে প্রতিদিন ৬৯ হাজার টাকা পরিশোধ করতাম। কিন্তু এখন পরিশোধ করি প্রতিদিন ৯০ হাজার।’

তিনি বলেন, ‘ওই সময় স্পিড বোটের ভাড়া ছিল জনপ্রতি ৪০০ টাকা। গত ৮-৯ বছরে সাধারণ যাত্রী ও সংবাদকর্মীদের অনুরোধে কয়েক দফায় জনপ্রতি ২৫০ টাকা পর্যন্ত কমানো হয়েছে। এই কয়েক বছরে জেলা পরিষদের ইজারার মূল্য বেড়েছে। কিন্তু স্পিডবোটের ভাড়া বাড়েনি বরং কমেছে।’

এদিকে ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনসহ সন্দ্বীপের বাসিন্দারা। আগের ভাড়া ফিরিয়ে না আনলে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ঘোষণাও দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সন্দ্বীপ ছাত্র ফোরামের সাবেক সভাপতি ওমর ফয়সাল বলেন, ‘সন্দ্বীপের অন্যতম নৌরুট কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটের পরিচালনার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিআইডব্লিওটিএকে দিতে হবে। এছাড়া এ নৌরুটকে নৌ বন্দর ঘোষণা করে ইজারাপ্রথা থেকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। যাতে করে যে কেউ নিয়মনীতি মেনেই আধুনিক নৌযান এ রুটে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালনা করতে পারে।

এদিকে জানা গেছে, আকস্মিক ভাড়া বাড়ানোর ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লিউটিএ দ্রুত এই বিষয়ে ইজারাদারের সাথে বৈঠকে বসবে।

চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল বলেছেন, ‘ভাড়া বাড়ানোর এই বিষয়ে আমরা অবগত। আমরা ইজারাদারের সাথে বসবো কী ঘটেছে। আমরা ইজারাদারের কথা শুনবো এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার থাকলে আমরা দেবো।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!