চবি ক্যাম্পাসে থাকতে চান না কেউ, তবু ৪ ভবন তৈরির নতুন বাহানা

১০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রস্তাব ইউজিসিতে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২৫ ভাগ ফ্ল্যাটই খালি পড়ে আছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও নানা কারণে ক্যাম্পাসে থাকতে অনীহা। তবু তাদের থাকার জন্য নতুন করে ১০ তলা করে চারটি ভবন নির্মাণ করতে চাইছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমন কাণ্ড নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারাই।

জানা গেছে, অতিরিক্ত ভাড়া, পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব, ভালো মানের স্কুল-কলেজ না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে ক্যাম্পাসের নির্ধারিত ফ্ল্যাটে থাকতে অনীহা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। যার কারণে দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে আছে ২৫ শতাংশ ফ্ল্যাট। কিন্তু এরপরও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জন্য নতুন করে ১০ তলা করে চারটি ভবন নির্মাণ করতে চেয়ে সম্প্রতি ইউজিসিতে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে ফ্ল্যাট খালি থাকার পরও নতুন ভবন নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডিন বলেন, শিক্ষকদের জন্য যে বাসাগুলো আছে সেগুলো নিয়মিত সংস্কার করা হয় না। কোন কিছু নষ্ট হয়ে গেলে প্রকৌশল দপ্তরে ফোন দিলে তারা বরাদ্দ নেই জানিয়ে সংস্কার করেন না। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার জন্য ভালো মানের কোন স্কুল-কলেজ নাই। শহরের তুলনায় নাগরিক সুবিধা একেবারে নেই বললেই চলে। তাই শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে থাকতে চান না।

পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউজিসিতে ১০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাঠানো হয়। যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা দুটি হল, হলের প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের জন্য দুটি ভবন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারন্যাশনাল হাউজ, গেস্ট হাউজ, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ১০ তলা করে চারটি ভবন, টিএসসিসহ বেশকিছু প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়।

প্রকৌশল দপ্তরের তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় তিন হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ২৬৩ জনের। এর মধ্যে ৯ শতাধিক শিক্ষক ও চার শতাধিক কর্মকর্তার জন্য ফ্যামিলি ফ্ল্যাট রয়েছে ১১০টি। এরমধ্যে ৮৬ টি ফ্ল্যাট বিভিন্ন শিক্ষক কর্মকর্তার নামে বরাদ্দ থাকলেও ২৪টি খালি। অন্যদিকে ব্যাচেলর শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য রুম রয়েছে ৩২টি। এরমধ্যে ১৫টি খালি। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য ফ্ল্যাট রয়েছে ৪২টি। এরমধ্যে খালি আছে সাতটি। এছাড়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য ৭৯টি ফ্ল্যাট থাকলেও ২৪টি দীর্ঘদিন ধরে কেউ বরাদ্দ নেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. এমদাদুল হক বলেন, ‘শিক্ষকেরা ক্যাম্পাসে কেন থাকে না— এটা বলা মুশকিল। তবে প্রধান কারণ আমার মনে হয় ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার একটা বিষয় আছে। ক্যাম্পাসের কলেজটার কোয়ালিটি নাই। যার কারণে অধিকাংশ শিক্ষকই ছেলেমেয়েদের শহরে ভর্তি করাচ্ছেন। তাই একটু কষ্ট হলেও শহরে থাকছেন। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, শিক্ষকদের থেকে যে বাসা ভাড়া কেটে নেওয়া হয়, এই বাসাগুলো সেই মানের না।’

বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ হামিদ হাসান নোমানী বলেন, ‘ক্যাম্পাসের বাসায় না থাকার একমাত্র কারণ আমরা যে ঘরভাড়া পাই, যদি সরকারি বাড়িতে থাকি তাহলে সেটা শতভাগ কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের থেকে যে টাকা কেটে নেয়, ঘরগুলো সেই মানের নয়। এখানে যারা থাকেন, তারা মানবেতর জীবনযাপন করেন। আর নিয়োগে যাদের শর্ত আছে ক্যাম্পাসে থাকতে হবে, তারাই থাকেন না। তাহলে আমরা কেন থাকবো?’

বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতির ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ বাচ্চু বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ঘর ভাড়া বাবদ যে টাকা কেটে নেয়, সেই মানের ঘর দেয় না। তাই কর্মচারীরা থাকতে চায় না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন প্রকৌশলী বলেন, ‘কিছু বাসা আছে যেগুলোতে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে কেউ থাকে না। সংস্কার করলে অনেক বাসা ব্যবহার উপযোগী করা যাবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আলতাফ-উল-আলম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে যে থিম ছিল সেটা হলো এটা সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এটা হয়ে উঠেনি। এখন পুরনো থিম অনুযায়ী মাস্টারপ্ল্যানে এগুলো ইনপুট করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানে আরও ভবনের কথা আছে। আমরা ক্রমান্বয়ে তা বাস্তবায়ন করবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাসা যেগুলো খালি আছে সেগুলোতে সংস্কার কাজ করানো হলে ব্যবহার উপযোগী করা যাবে। এটা প্রকৌশল দপ্তর দেখবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে, সে পরিমাণ বাসা নাই। অথচ এটা পরিপূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। যেগুলো খালি আছে সেগুলো ৪০-৫০ বছর আগের বাসা। সেগুলো নতুন করে সংস্কার করতে হবে। যে বাসায় আমি থাকবো, সেটা যদি আমার স্ট্যান্ডার্ডের না হয়, তাহলে কেন থাকবো?’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে ডিপিপি জমা দেওয়া। জমা দিলেই তা পাশ হয়ে যায় না। এটার অনেকগুলো প্রসেস আছে। আর আমরা সিদ্ধান্ত নিলেও হবে না। এটার অনেকগুলো ধাপ আছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!