চবির ‘স্মার্ট’ ছেলেটি যেভাবে হয়ে উঠল ভয়ংকর জঙ্গি

প্রেমিকার বিয়ে হঠাৎ বদলে দেয় সবকিছু

স্বভাবে যথেষ্ট বিনয়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মো. এমরান। ঝুপড়ির আড্ডায় কিংবা বিবিএ অনুষদ ক্যাফেটেরিয়ার হৈ-হুল্লোড়েও ছিল তার নিয়মিত অংশগ্রহণ। এক মেয়ের সঙ্গে ছিল তার প্রেমের সম্পর্কও। বিভাগের অনুষ্ঠান হলে ‘শুটেড-বুটেড’ হয়ে আসা এমরানের গলায় ঝুলতো টাইও। নিয়মিত ক্লাসের পাঠেও অংশ নিতেন এমরাম।

কিন্তু গত এক বছর ধরে ছন্দপতন ঘটে ইমরানের চালচলনে। শেষ দুই সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ের আসা শুরু করে লম্বা পাঞ্জাবি ঝুলিয়ে। ক্লাসে আসার সময় তার মাথায় কখনও কখনও টুপিও উঠেছে। আবার কিছুদিনের জন্য টানা ক্লাসে আসা বন্ধ থাকতো তার। বন্ধুরা অনুপস্থিতির কারণ জানতে মোবাইলে কল দিলেও পাওয়া যেত না তাকে। ক্লাসে ফিরে আসলেও একেকসময় দেখাতেন একেক অজুহাত।

আবার ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে তার কথাবার্তা হয়ে পড়ে সীমিত। চুপচাপ হয়ে যাওয়ায় বন্ধুরাও তেমন একটা মেলামেশা করতো না তার সাথে।

তার কেনই বা এই পরিবর্তন— এমন প্রশ্নের উত্তর কি খুঁজেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা? বন্ধুদের কেউ কি আর জানে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এমরান যে পা বাড়িয়েছে জঙ্গিবাদের অন্ধকার জগতে?

তাদের কেউই জানতো না, আড্ডা কিংবা পড়াশোনাকে পেছনে রেখে সহিংসতা চালানোর নেশায় যে বুঁদ হয়ে থাকতো এমরান। বন্ধুদের স্বাভাবিক সব ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে এমরান নাম লিখিয়েছে জঙ্গি সংগঠন ‘নব্য জেএমবি’র খাতায়।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) রাতে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকায় ট্রাফিক পুলিশবক্সে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ৫ জন আহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে দুজন সেখানে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্য।

আর এ ঘটনায় সরাসরি অংশ নেওয়া সাত জঙ্গির একজন চবি বিবিএ অনুষদের মার্কেটিং বিভাগের এই শিক্ষার্থী। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের হাতে গ্রেফতার হন এমরানসহ তিন নব্য জেএমবির সদস্য। রোববার (৩ মে) নগরীর বাকলিয়া ডিসি রোডের একটি বাসা থেকে রোববার তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

তার বিভাগের কয়েকজন বন্ধু ও শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে নগরীর ২ নম্বর গেইট এলাকায় থাকতো এমরান। চুপচাপ স্বভাবের ছিল। পড়াশোনা ও নিজের খরচের অর্থ যোগান দিতেন টিউশন করে। রেজাল্টও ভালো ছিল। সপ্তম সেমিস্টারে তার অর্জিত পয়েন্ট ছিল ২.৯০। মার্কেটিং এর শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেয়। কিন্তু তাকে বন্ধুরা বললেও তিনি দিতেন সময় না থাকার অজুহাত। কিন্তু তার টিউশন ছিল মাত্র একটি।

তারা আরও জানান, প্রথম তিন বছর সে ক্লাসে আসতো নিয়মিত। ঝুপড়িতে আড্ডায় নিয়মিত আসতো সে। ক্যাফেটেরিয়ায় গানও ধরতো বন্ধুদের সঙ্গে গলা ছেড়ে। বিভাগ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে ফরম্যাল ড্রেস পরতো। মাঝেমধ্যে পড়ে আসতো শ্যুট-টাইও। আগে সে সিগারেট খেতো। এক বছর ধরে সিগারেট ছেড়ে দেয়।

বন্ধুরা আরও জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমরানের ৫ জনের একটা সার্কেল ছিল। সেই সার্কেলে ছিল চট্টগ্রামের একজন জনপ্রতিনিধির পিএস এর সন্তানও। কিন্তু সর্বশেষ গত ২২ নভেম্বর বিভাগ থেকে সেন্টমার্টিন ট্যুরে যায় সে। সেখান থেকে ফিরার পর সে তার সার্কেলের বন্ধুদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখা শুরু করে।

তার বন্ধুরা জানায়, একটি মেয়ের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ২২ নভেম্বরের ট্যুর থেকে ফেরার পর জানা গেছে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। সম্ভবত ডিসেম্বর মাসেই মেয়েটির বিয়ে হয়। এরপর থেকে এমরান একেবারেই নীরব হয়ে যায়। ক্লাসে আসাও কমিয়ে দেয়।

তারা আরও জানান, গত ছয় মাসে তার চালচলনে শতভাগ পরিবর্তন আসে। কথাবার্তাও একপ্রকার থেমে যায় বন্ধুদের সঙ্গে। গায়ে উঠে সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা। কখনো কখনো টুপিও দিতো মাথায়। গলায় ঝোলা লাল-সাদা গামছাও।

তার বন্ধুদের কয়েকজন বলেন, ‘তার এ পরিবর্তন আমরা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমরা ভেবেছি সে আঘাত পেয়েছে মনে। এ কারণে হয়তো ভেবেছি, তাবলীগ জামায়াতের সঙ্গে সে মেলামেশা শুরু করেছে, ইসলামী বিধান সে পালন করার চেষ্টা করছে, তাই আমাদের আড্ডা, গানে সে আর আসছে না। তবে কখনো আমাদের তার মত হয়ে সে চলতে বলেনি। কখনো নামাজেও যেতে বলেনি। আমাদের সঙ্গে কথা কমিয়ে দেওয়ায় আমরাও আর সেভাবে তাকে আড্ডা দিতে ডাকিনি।’

তার বন্ধুরা আরও বলেন, ‘সোমবার (৪ মে) জঙ্গিদের ছবি প্রকাশের পর তা ছবি সেখানে দেখে আমরা সবাই অবাক হয়েছি। কারণ আমাদের কেউ কল্পনাও করিনি তার মত শান্ত ছেলে এ ধরনের কাজে যুক্ত হতে পারে।’

চবি মার্কেটিং বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাভেদ হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি কিছুক্ষণ আগে তার বিষয়টি জানতে পেরেছি। সে কিভাবে কী হয়ে গেছে তা আমি বলতে পারবো না। সে আমাদের বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারের ছাত্র। শান্ত স্বভাবের ছেলে। গত নভেম্বরে সে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ট্যুরে গিয়েছে। সেখানে তার সাথে আমার দেখাও হয়েছে। সবার সাথে গল্প, আড্ডা, হাসি ঠাট্টা সব করছে। সম্প্রতি সে নামাজ কালাম নিয়মিত পড়া শুরু করে। সপ্তম সেমিস্টারে থাকা অবস্থায় সে কিছুটা অনিয়মিত ছিল। ছাত্র হিসেবে সে নরমাল ক্যাটাগরির।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর এস এম মনিরুল হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা তার বিষয়টি জানতে পেরেছি। তার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার পলাশ কান্তি নাথ জানিয়েছেন, বাকলিয়া ডিসি রোডের একটি বাসা থেকে রোববার এমরানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা ২৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকায় পুলিশবক্সে বোমা হামলায় জড়িত।

গ্রেপ্তার বাকি ২ জন হলেন মো. সাইফুল্লাহ (২৪) ও আবু ছালেহ (২৫)। আবু ছালেহ একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের টেক্সটাইল অনুষদের শিক্ষার্থী। সাইফুল্লাহ চকবাজার একটি কম্পিউটারের দোকানের কর্মচারী।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!