চট্টগ্রাম মেডিকেলে ওষুধ চোরদের ‘টার্গেট’ গাইনি ওয়ার্ড, চুরিতে একজোট সর্দার-নার্স

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ৩৩ নম্বর গাইনি ওয়ার্ড ঘিরে ওষুধ চুরি ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিদিনই রোগীর ওষুধ চুরি করে একটি চক্র। পরে বাইরের দোকানে বিক্রি করা হয় সেসব ওষুধ। এসব কাজের নাটের গুরু ওয়ার্ডের এক সর্দার। তিনি আবারও ওয়ার্ডের এক সহকারী অধ্যাপকের এটেনডেন্টও। ফলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পায় না পুলিশও। এছাড়া ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের বিভিন্নভাবে ওই ডাক্তারের কাছে যেতে প্রলুব্ধ করেন তিনি। এসব কাজে তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন নার্স ও আরেক সর্দার।

অভিযুক্ত ওই ওয়ার্ড সর্দারের নাম লিয়াকত হোসেন। তিনি গাইনি ওয়ার্ডের সর্দারের পাশাপাশি ডা. ফাহমিদা চৌধুরীর এটেনডেন্ট। সন্ধ্যায় ওয়ার্ডে ডিউটি থাকলে তা ফেলে তিনি ডাক্তারের চেম্বারে চলে যান। তার দুই সহযোগীর একজন স্টাফ নার্স নাসরিন জাহান ও অপরজন সর্দার বাদশা।

অভিযোগ রয়েছে, সিজার হওয়া রোগীদের ডা. ফাহমিদা চৌধুরীর কাছে যাওয়ার জন্য তারিখ দিয়ে রাখেন লিয়াকত। এছাড়া প্রসব ও পোস্ট অপারেটিভ রোগীদেরও ডা. ফাহমিদার কাছে পাঠাতে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করেন তিনি।

জানা গেছে, গাইনি ওয়ার্ডে প্রসবপূর্ব কোনো রোগী আসলে প্রাথমিক অবজারভেশনের পর ভর্তি করিয়ে ওষুধের তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। তালিকা অনুযায়ী যেসব ওষুধ এনে দেওয়া হয়, তার অর্ধেকই লাগে না। কিন্তু ওষুধ থেকে যাওয়ার পরও সেসব রোগীর স্বজনদের ফেরত দেওয়া হয় না। এসব ওষুধ সরিয়ে ফেলেন নার্স নাসরিন। পরে সুযোগ বুঝে লিয়াকত ওষুধগুলো বাইরের দোকানে বিক্রি করে দেন।

আরও জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলে সবচেয়ে বেশি দালালের আনাগোনা ৩৩ নম্বর গাইনি ওয়ার্ডে। আর এদের নাটের গুরুও ওয়ার্ডের সর্দার লিয়াকত। গাইনি ওয়ার্ডে রাত ২টার পর গিয়ে বিভিন্নভাবে রোগীদের বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে প্রলুব্ধ করেন লিয়াকত। এমনকি রোগীদের ‘পরিচিত দোকানের’ কথা বলে ৯০০ টাকার ওষুধ কিনে দেন প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। এভাবে ওষুধ বিক্রি করে দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে সেই দোকানদারের কাছ থেকে পান ‘কমিশন’।

গত ১৭ আগস্ট ৩৩ নম্বর গাইনি ওয়ার্ডের ফটকের সামনে লিয়াকতকে কাপড়ে মোড়ানো ওষুধসহ হাতেনাতে ধরে ফেলে পুলিশ ফাঁড়ির সদস্য দেবব্রত। কিন্তু পরে ওষুধগুলো এক আত্মীয়ের জন্য কেনা বলে পার পান লিয়াকত।

একই ঘটনা পুনরায় ঘটে গত ২৭ সেপ্টেম্বর। লিয়াকত ওইদিন রাত আড়াইটায় একটি খোলা কার্টনে করে ওষুধ নিচে নামানোর সময় মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নূরুল আলম আশেকের হাতে ধরা খান। কিন্তু আশেককে ‘ম্যানেজ’ করে ছাড়া পান লিয়াকত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাইনি ওয়ার্ডের এক সিনিয়র স্টাফ নার্স লিয়াকতের ওষুধ চুরির বিষয়টি জানান।

এর আগে চলতি বছরের ২০ এপ্রিল ৩৩ নম্বর গাইনি ওয়ার্ডের অফিস সহায়ক রতন দত্তকে আটক করে পুলিশ। তখন নুরুল আলম আশেক বলেছিলেন, সকালে ৩৩ নম্বর গাইনি ওয়ার্ড থেকে ওষুধ চুরি করার সময় হাতেনাতে ওই অফিস সহকারীকে আটক করা হয়।

গত ৯ এপ্রিলও একই অভিযোগে মো. সাদ্দাম হোসেন (৩৩) নামের হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের এক ওয়ার্ডবয় আটক করে পুলিশ। এর আগে ৩৩ নম্বর গাইনি ওয়ার্ডের ভেতর থেকে সজল চৌধুরী তুফান নামের ওয়ার্ডবয়কে আটক করে পুলিশ। এর কিছুদিন পর রাজীব বৈদ্য ও শুভ দাশ নামে দুই দালাল আটক হয় দুদকের একটি টিম।

এদিকে ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ও ৭ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে ওষুধ চুরির ঘটনায় দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে গত ১ জুলাই মেডিকেলের এক অফিস সহায়কের বাসায় থেকে উদ্ধার হয় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা মূল্যের কয়েক বস্তা সরকারি ওষুধ। ৭ জুলাই হাসপাতালের নিচতলার ৬ নম্বর লিফটের সামনে থেকে চুরি যাওয়া সরকারি ওষুধসহ আসামি সুমন বড়ুয়া আটক হয়। তাকে সহায়তা করে পরিচ্ছন্নতাকর্মী শাহ আলম।

দুই মামলায় হাসপাতালের আটজন চুক্তিভিত্তিক ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ২৭ ধরনের ওষুধ চুরির মামলায় পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হয়। যাদের সবাই হাসপাতালের মৌখিক চুক্তিভিত্তিক ওয়ার্ডবয়। চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, এই মৌখিক চুক্তিভিত্তিক ওয়ার্ডবয়রাই ওষুধ চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছে। আসামিরা অজ্ঞাত ব্যক্তিদের কাছে সরকারি ওষুধ বিক্রি করে। তাই সরকারি ওষুধ ক্রেতাদের শনাক্ত করা যায়নি।

এই বিষয়ে মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নূরুল আলম আশেক বলেন, ‘লিয়াকত ও বাদশা ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সর্দার। এটি সেনসেটিভ ওয়ার্ড। তাই বিভিন্ন সময় এদের দু‘জনকে ডেকে কিছু কথাবার্তা জিজ্ঞাসা করি, পরামর্শ দিই। আর ওষুধ চুরির খবর আমরা তো মিডিয়াকেই আগে জানাই।’

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ওয়ার্ডমাস্টার কামরুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘লিয়াকত ও বাদশার ওষুধ চুরির ঘটনা আমি কয়েকবার পুলিশ ফাঁড়িতে জানিয়েছি। কিন্তু পুলিশ এসে অন্যজনকে ধরে নিয়ে যায়। আমি হাসপাতাল পরিচালককে এদের দু’জনের বিষয়ে লিখিতভাবে জানাবো বলে ভাবছি।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে লিয়াকত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি ওষুধ চুরি করি—এটি সত্যি হলে পুলিশের হাতে ধরা খেতাম। ৩৩ নম্বর গাইনি ওয়ার্ড থেকে অনেকেই ধরা খেয়েছে, আমার নাম তো কখনও আসেনি। আর ডা. ফাহমিদা চৌধুরী চট্টগ্রামে বিখ্যাত গাইনি ডাক্তার। তার কাছে অনেকেই সিরিয়াল চান। আমি ওয়ার্ড থেকেই ব্যবস্থা করে দিই। এটাতে দোষের কিছু তো দেখছি না। আর স্টাফ নার্স ইনচার্জ নাসরিন আপা মাঝে মাঝে কিছু ওষুধ আমার কাছে রাখতে দেন।’

লিয়াকতের বিষয়ে জানতে গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. ফাহমিদা চৌধুরীর মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

স্টাফ নার্স ইনচার্জ নাসরিন জাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘রোগীর জন্য যা ওষুধ এনে দেওয়া হয়, সব রোগীর কাজে লাগে। ওষুধ চুরির সুযোগ নেই।’

চট্টগ্রাম মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসানের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওষুধ চুরির বিষয়ে আমি জিরো টলারেন্স। ওষুধ চুরির ক্ষেত্রে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডকে বরাবরই আমি সন্দেহজনক তালিকায় রেখেছি। পুলিশকে বলা আছে, কোনোভাবেই ওই ওয়ার্ডের সর্দার, ওয়ার্ডবয় ও নার্সদের যেন তারা নজরদারি থেকে বাদ না দেয়।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!