চট্টগ্রাম মেডিকেলের প্রসূতি ওয়ার্ডে তিনগুণ রোগী নিয়ে দুই জীবনের ‘সেবা’, বাচ্চা প্রসব করায় আয়ারা

ডাক্তারদের প্রচেষ্টা ভেস্তে যাচ্ছে কর্মচারীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে

রাত আড়াইটা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৩ নং গাইনি প্রসব-পূর্ব ওয়ার্ড। হাসপাতালের ৬ তলায় ৩৩, ৩৪ ও ৩১ নং ওয়ার্ডজুড়ে গাইনি ওয়ার্ড। প্রতি রাতে ৬ তলা জুড়ে কিলবিল করে রোগীর স্বজন। ওয়ার্ডের বারান্দা কিংবা গেটের কাছে তারা ভিড় করে থাকে। রাতে ঘুমায় ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দায়। এই সংখ্যা হাজারখানেকের কম নয়। তাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকে দালাল। গেটের বাইরে অপেক্ষা তাদের। সেই দালালের মধ্যে কী নেই? প্রাইভেট ল্যাবের হাসপাতালের বাইরের ফার্মেসিগুলোর এজেন্ট, এমনকি নবজাতক জন্মের পর আজান দেওয়ার জন্য মুয়াজ্জিন— আরও কতো কী!

ওয়ার্ডের বাইরে গেটের মুখে লাঠি হাতে বসে থাকেন আনসার। আর চেয়ারে ঢুলুঢুলু ঘুম চোখে বসে থাকেন ওয়ার্ডবয় তুফান। তুফানের সহকারী আছেন আরও ৩ জন। তারা রোগীর কাছ থেকে ১০০ টাকা করে লেবার পেইন উঠা রোগীকে ভিতরে পাঠিয়ে স্বজনকে আবারও ১০০ টাকা হাতে নিচে পাঠিয়ে দেন চূড়ান্ত ভর্তির টিকেটের জন্য। রোগীর স্বজনকে আবারও দ্বিতীয় দফায় টিকিট আনতে নিচে গিয়ে ব্যয় করতে হয় আধাঘন্টা বা ঘন্টাখানেকের বেশি সময়।

জরুরি বিভাগ থেকে ভর্তি টিকেট আনার পর রোগীকে পাঠানো হয় অবজারভেশন রুমে। দুজন ইন্টার্ন চিকিৎসক তাদের দেখে পাঠিয়ে দেন লেবার রুমে। সেখানে বসে থাকেন রাতের শিফটের মেডিকেল অফিসাররা। স্বাভাবিক প্রসবের রোগীদের ডেলিভারির জন্য মিডওয়াইফারি নার্সদের ওপর দায়িত্ব থাকলেও ওই কাজটি করেন আয়ারা। আর প্রসবপূর্ব রোগী ও বাচ্চার অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিজারিয়ান রুমে। কিন্তু সেখানে অপারেশন টেবিল রয়েছে মাত্র একটি। সংকটাপন্ন রোগী হলে অপারেশন থিয়েটারের টেবিলের জন্য রোগীদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়।

আর এভাবেই চলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডে প্রসব-পূর্ব মা ও প্রসবোত্তর নবজাতকসহ দুই জীবনের সেবা। তবে এসব সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বিভাগের গাইনি প্রধান জানান, মূলত লোকবল ও আয়া, নার্স ও চতুর্থ শ্রেণির কমর্চারীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভেস্তে যাচ্ছে তাদের সব প্রচেষ্টা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শর্মিলা বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ওয়ার্ডে চারটি ইউনিটে সহকারী রেজিস্ট্রার ও ইনডোর মেডিকেল অফিসারের সংকট রয়েছে। মূলত তিন ভাগের একভাগ লোকবল দিয়ে এ ওয়ার্ডের কার্যক্রম চলছে। মূলত এমডি শিক্ষার্থীরাই এ ওয়ার্ডের চিকিৎসা কার্যক্রম সচল রেখেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৩ নম্বর গাইনি ওয়ার্ডে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এই প্রতিবেদকের সরেজমিন সারারাত ওয়ার্ডে অবস্থানে দেখা গেছে, স্বাভাবিক প্রসবের রোগীদের নার্সরা দেখভাল করেন না। ওয়ার্ডের মধ্যেই কাপড় দিয়ে ঘিরে রেখে আয়ারা স্বাভাবিক প্রসব করিয়ে থাকেন। ‘মাসী’ নামধারী আয়ারা রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে দুর্ব্যবহারও করেন মুহূর্তে মুহূর্তে। নবজাতক জন্মের পর নির্দিষ্ট মুয়াজ্জিনকে দিয়ে আজান দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। বাইরে থেকে ওষুধ নিয়ে আসার জন্য পূর্ব গেট ও পশ্চিম গেটের ওষুধের দোকানদাররা এজেন্ট নিয়োগ করে থাকে ওয়ার্ডের বাইরে। ওয়ার্ডের ভেতর থেকে হাসপাতাল কর্মীরা এসব এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। আনসারদের ঘুষবাণিজ্য তো রয়েছেই যথারীতি। যতো জরুরি প্রয়োজনই থাকুক না কেন, তাদের টাকা দিয়েই ভিতরে ঢুকতে হয় রোগীদের স্বজনদের।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৩ নং প্রসবপূর্ব ওয়ার্ডে শয্যার সংখ্যা ৪৮টি। অথচ এর বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে ১৪০ জনেরও বেশি প্রসূতি সেবা নিতে আসেন। অন্যদিকে প্রসবোত্তর ওয়ার্ডে শয্যাসংখ্যা ৬৪টি। সেখানে ১০০ জনেরও বেশি প্রসূতি ও তাদের নবজাতকদের থাকতে হয়।

হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে ৩৩ ও ৩৪ নং ওয়ার্ড নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় প্রসূতি বিভাগ। ২৬ বছর আগে সংযোজন হওয়া ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি অপারেশন টেবিলের মধ্যে একটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে পুরোপুরি। সাত লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে ছয়টি লেবার টেবিলের মধ্যে সচল রয়েছে দুটি মাত্র টেবিল। ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি অ্যানেসথেসিয়া মেশিনের একটি নষ্ট। অন্যদিকে ওয়ার্ডর বাইরে বারান্দায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে প্রায় ১৫ লাখ টাকার ১০টি এসি, সাড়ে পাঁচ লাখ টাকায় তিনটি ভায়াথোলজি মেশিন, তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকায় তিনটি অপারেশন লাইট, বাচ্চার শরীর উষ্ণ রাখার জন্য সাড়ে সাত লাখ টাকার একটি মেশিন, পৃথক ‘ওয়াশিং এন্ড অটো ক্লিনিক স্পেস’, রোগীদের জন্য পৃথক গাউন ও ক্যাপ সব পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!