চট্টগ্রামে দুই ল্যাবের রিপোর্টে ‘ক্যান্সার’, ভুল অপারেশনে মৃত্যুর আগে জানা গেল কিছুই ছিল না

তড়িঘড়ি অপারেশনের ৯ দিন পর মৃত্যু

চট্টগ্রামের নামি দুই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টে এক গৃহবধূর খাদ্যনালীতে শনাক্ত হয় ক্যান্সার। এমন দুঃসংবাদে উদ্বিগ্ন স্বজনরা ডাক্তারের পরামর্শে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় দেড় লাখ টাকা ব্যয়ে সেই অপারেশনের পর রোগীর শরীর পাওয়া টিস্যু চট্টগ্রামেরই অন্য একটি বিশেষায়িত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার পর দেখা গেল, সেখানে ক্যান্সারের কোনো উপস্থিতিই নেই। কিন্তু অপারেশন-পরবর্তী তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ওই গৃহবধূ মাত্র নয় দিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

রোগ-নির্ণয়ের ভুলে এমন মর্মন্তুদ ঘটনার শিকার হওয়া ওই গৃহবধূর নাম আইনুর নাহার সীমা। চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থানার ঈদগাঁ বউবাজার এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম ভুঁইয়ার স্ত্রী তিনি। তার একটি পুত্র এবং কন্যাসন্তান রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে থাকার একপর্যায়ে গৃহবধূ আইনুর নাহার সীমা বেশ কয়েকজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। এর মধ্যে একজন ডাক্তারের পরামর্শে চট্টগ্রামের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার এপিক হেলথকেয়ারে গত ২৫ জুলাই পেটের আলট্রাসনোগ্রাম করান।অধ্যাপক ডা. মো. দিদারুল আলম স্বাক্ষরিত সেই রিপোর্টে ক্যান্সারের জীবাণু পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়।

এরপর ক্যান্সারের বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে একই পরীক্ষাটি আবার করানো হয় নগরীর আরেক বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার শেভরন ল্যাবে। সেখানেও ক্যান্সারের জীবাণু পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয় রিপোর্টে।

এরপর গৃহবধূ আইনুর নাহার সীমার স্বজনরা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. আলী আজগরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি রেফার করেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সাইফুল হকের কাছে। দুই ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পাওয়া রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে খাদ্যনালীতে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন ডা. সাইফুল।

চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশে নিজের মালিকানাধীন একুশে হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডে ৮ আগস্ট অপারেশন করানো হয়। ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকার সেই অপারেশনের ৬ দিন পর গৃহবধূ সীমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।

এর মধ্যেই ৮ আগস্ট অপারেশন করে ওই গৃহবধূর শরীর থেকে অপসারণকৃত টিস্যুটি চট্টগ্রামের চন্দনপুরার বিশেষায়িত সাইটো-সাইট ল্যাবে নিয়ে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করান তার স্বজনরা। সেই ল্যাবের দেওয়া রিপোর্টে অপসারণকৃত টিস্যুতে ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে গৃহবধূ সীমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর অপারেশনের জায়গা দিয়ে রক্ত ও পুঁজ বের হতে থাকে। ডাক্তার সাইফুলকে বিষয়টি জানানোর পর তিনি ওই গৃহবধূকে একুশে হাসপাতালেরই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার স্বজনদের জানান, গৃহবধূ সীমার খাদ্যনালীতে একটি ফুটো হয়ে গেছে।

ডা. সাইফুল রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) সকাল ১০টায় গৃহবধূ সীমাকে ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময়ই তার পালস ছিল না। এরপরও ডাক্তার দুটি ইনজেকশন দেন। সন্ধ্যার দিকে স্বজনরা বুঝতে পারেন, আইনুর নাহার সীমা আর বেঁচে নেই। অপারেশনের নয়দিন পর বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় ওই গৃহবধূ মারা যান।

ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুল রিপোর্ট এবং ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার ফলেই ওই রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ স্বজনদের। তবে অপারেশন করা  ডাক্তারের দাবি, রোগীর মৃত্যু হয়েছে কার্ডিয়াক এরেস্টের (হৃৎকম্পন পুরোপুরি বন্ধ‌) ফলে।

যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই ডাক্তার সাইফুল হক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। এছাড়া পাঁচলাইশের মির্জারপুল সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় ‘একুশে হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি হাসপাতাল রয়েছে তার।
 
মারা যাওয়া ওই গৃহবধূর ভাসুর মো. শফিক অভিযোগ করে বলেন, ‘ডাক্তারের অবহেলা এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুল রিপোর্টের কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। রোগীর সমস্যা নির্ণয়ের জন্যে আমরা শেভরন এবং এপিকে টেস্ট করাই। সেখানের রিপোর্টে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। তার ভিত্তিতে আমরা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. আজগরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। উনি আবার রেফার করেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সাইফুল হকের কাছে। তিনি ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকার বিনিময়ে অপারেশন করার কথা জানান।’

অপারেশনেও অবহেলার অভিযোগ এনে মো. শফিক বলেন, ‘এরপর পাঁচলাইশে ওনার মালিকানাধীন একুশে হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডে ৮ আগস্ট অপারেশন করানো হয়। অপারেশনটা আসলে উনি আসলে মনোযোগ দিয়ে করেননি। আমাদের বলা হয়েছে এটি পাঁচ ঘন্টার অপারেশন। সেটি উনি সোয়া দুই ঘন্টার মধ্যেই করে ফেললেন। অপারেশন করার সময় ছিদ্র করে ফেলছে। ৯ দিন ভর্তি রাখার কথা বলা হলেও ৬ দিনের মাথায় উনি রিলিজ করে দেন। বাসায় আসার পর অপারেশনের জায়গা দিয়ে রক্ত ও পুঁজ বের হয়।’

তিনি বলেন, ‘ডাক্তারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করে আবার সেই একুশে হাসপাতালে নিয়ে যাই এবং তিনি ড্রেসিং করে দেওয়ার পরেও কোন উন্নতি হয়নি। এরপর ফোন দিলে তিনি আবারও একুশে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। এরপর ওটিতে নিয়ে চেক করে নিজেই স্বীকার করেন এখানে একটি ফুটো হয়ে গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নিতে হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।’
 
গৃহবধূর ভাসুর মো. শফিক বলেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০ টায় ডা. সাইফুলের পরামর্শে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করাই। এরপর আজ সকালে রোগীর পালস ছিল না। পালস না থাকা অবস্থাতেই দুটি ইনজেকশন দিছে। সন্ধ্যায় বুঝতে পারি সে দুনিয়াতে আর নেই।’

তিন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই টেস্টের ভিন্ন রিপোর্ট দিয়েছে— এমন অভিযোগ তুলে মো. শফিক বলেন, ‘অপারেশন করার পরে ক্যান্সার আক্রান্ত যে টিস্যুর কথা বলা হয়েছে সেটি চট্টগ্রামের স্বনামধন্য ল্যাবরেটরি সাইটো-সাইটে পাঠাই। ওখানের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ডাক্তার সাহাবুদ্দিন সাহেব ৪-৫ বার এটা পরীক্ষা করে বললেন এখানে আমি ক্যান্সারের কোন টিস্যু এখানে পাইনি। ক্যান্সারের টিস্যু এটা অসম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘তাহলে আমাদের প্রশ্ন হল শেভরন যে এন্ডোসকপি করল, এপিক যে টেস্টগুলো করে ক্যান্সারের রিপোর্ট দিল সেগুলো আসলে কী ছিল?’— বলেন তিনি।

এদিকে যা দিকে অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে, সেই ডাক্তার সাইফুল হক নিজেকে সার্জারির বিষয়ে অভিজ্ঞ উল্লেখ করে দাবি করেন, তার অবহেলায় বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়নি। রোগীর মৃত্যু হয়েছে কার্ডিয়াক এরেস্টের ফলে।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে ডা. সাইফুল হক বলেন, ‘আমি সীমা নামে ওই রোগীর অপারেশন করেছি। রোগী ভালও হয়ে গেছে। আমি ৬ দিনের দিন রোগীকে ছেড়ে দিয়েছি বাসায় যাওয়ার জন্য। এটি তো ক্যান্সারের বড় অপারেশন। এন্ডোসকপি করে ডায়াগনোস করা যে ক্যান্সার। তো ছেড়ে দেয়ার পরে ৭ম দিন অপারেশনের জায়গায় একটু লিকেজ ছিল। যার ফলে আবার ভর্তি করে আবার রেখে দিলাম। এরপর বললাম দেখেন এটা তো লিকেজ। কয়েকদিন থাকা লাগতে পারে। আপনারা যদি মনে করেন ক্রাইসিস আছে তাহলে চট্টগ্রাম মেডিকেলে চলে আসেন।’

তিনি বলেন, ‘তারা মেডিকেলে নিয়ে গেলে সেখানে কেবিন ব্যবস্থা করে দিলাম। রোগী খাওয়া দাওয়া করেছে। সকালে প্রসাব-পায়খানা সবই হইছে। সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করে তার কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়। তখন আমার ৩ জন ডাক্তার সশরীরে উপস্থিত ছিল পাশে। এখন কার্ডিয়াক এরেস্টে তো কারও হাত নেই, তাই না?’

ডা. সাইফুল বলেন, ‘সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে আমার দুইজন ডাক্তার ফলোআপ দিতে গিয়ে দেখল হঠাৎ করে রোগীর শ্বাস কষ্ট, বুকে ব্যাথা—এসব লক্ষণ। এরপর ৩ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে রোগী মারা গেছে। এটি কার্ডিয়াক এরেস্ট। পেটের অপারেশনজনিত সমস্যা হলে রোগীকে কেউ খাবার দেয় বা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়?’

অপারেশনে অবহেলার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অপারেশনটা ৫ ঘন্টা সময় নিয়ে করেছি। আমি হলাম এই মুহূর্তে চট্টগ্রামের সিনিয়র মোস্ট মানুষ। আমার ওপরে একজন হেড আছে। ৫ ঘন্টা ধরে অপারেশন করেছি। করার পর রোগী ভাল। ৪৮ ঘন্টা পরে খাবার দিয়েছি। এরপর রোগী আরও ৪ দিন ছিল। ভাত, মাছ, মাংস সব খেয়েছে রোগী। এরপর আমরা নলটা খুলে দিলাম। এর দুইদিন পরে দেখা গেল সেখান থেকে ডিসচার্জ হচ্ছে। এরপর আবার তাদেরকে এনে নলটা পুনরায় স্থাপন করলাম। এরপর তারা বাড়ি চলে গেল।’

ডা. সাইফুল হক বলেন, ‘রোগীর অবস্থা খারাপ হলে আমরা রোগীকে আইসিইউতে নিয়ে যেতাম। স্বাভাবিকভাবে যার কেউ মারা যায় তারা একটু সেন্টিমেন্টাল থাকে। কিন্তু ১০ হাজার কেইস অপারেশন করলে একটা দুইটা কার্ডিয়াক এরেস্ট হইলে তো কিছুই করার নেই।’

এদিকে ডা. সাইফুল হকের দাবি অস্বীকার করে রোগীর স্বজনরা জানান, আমাদের রোগী অপারেশনের পর সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন না। মৃত্যুর আগেও তিনি রক্ত বমি করেছেন। উনি নিজের দোষ আড়াল করতেই এসব কথা বলছেন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!