চট্টগ্রামে থানায় মারা যাওয়া দুদকের ডিডিকে ফাঁসাতে ‘সমন গায়েব’ আদালতের পেশকারের

চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে সাবেক দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উপ পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর মৃত্যুর পর দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মিথ্যা মামলা, সমন গোপম করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করিয়ে তড়িঘড়ি করে থানায় পাঠানোসহ নানা বিষয়ে বেরিয়ে আসছে থলের বেড়াল। আদালতের পেশকারের কারসাজি জন্ম দিয়েছে নতুন এক চাঞ্চল্যকর ঘটনার। নেজারত শাখার প্রতিবেদনে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। উঠে আসছে সমন গায়েবের মাধ্যমে ওয়ারেন্ট বাণিজ্যের চিত্রও।

চট্টগ্রাম আদালত সূত্রে জানা যায়, সিএমপির চান্দঁগাও থানা হেফাজতে দুদকের উপ পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুর পর সমন ইস্যু বিষয়ে নেজারত শাখা থেকে প্রতিবেদন চাওয়া হয়। নেজারত শাখা ইতোমধ্যেই ওই মামলার সমনটি চট্টগ্রাম ৬ষ্ঠ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে পেশকার নেজারত শাখায় পাঠায়নি বলে জানা গেছে।

ওই আদালতে গত ৩০ আগস্ট স্মারক নং-৪৮৭৬ মূলে সমন লিখা হলেও নেজারত শাখায় ওই সমন আর যায়নি। ওটা বেঞ্চ সহকারী নিজেই আটকে রাখে এবং গোপন করে ওয়ারেন্ট করায়। আর ওই ওয়ারেন্ট ওই দিনই পাঠিয়ে দেওয়া হয় থানায়।

জানা যায়, সমনটি লেখা হলেও তা গোপনে রেখে দেন ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। এটি মামলার আসামিদের হাতে যাতে না পৌঁছায় সেজন্য কৌশলে নিজের ড্রয়ারে রেখে দিয়ে নেজারত শাখায় আর পাঠাননি।

পরে সমনকে কৌশলে গোপন করে মামলার ধার্য তারিখে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সমন ফেরত বিষয়ে মন্তব্য না চেয়েই ওই আদালতের বিচারক জামিনযোগ্য ৩২৩ ও ৫০৬ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে কি ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছিল? এই প্রশ্নটি এখন আদালত পাড়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

এদিকে আদালতের বেঞ্চ সহকারিদের সঙ্গে এই ওয়ারেন্ট বাণিজ্যে কারা জড়িত রয়েছে তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে পুলিশের একটি সংস্থাও।

মামলা সূত্রে জানা যায়, একজন নারীকে দিয়ে মামলাটি সাজানো হয়েছে। এসব মামলায় সচরাচর তদন্তের জন্য পুলিশের বিভিন্ন সংস্থাকে নির্দেশ দিয়ে থাকেন আদালত। কিন্তু এই মামলায় সমন দেওয়া হলেও তা কৌশলে লুকিয়ে রাখা হয়।

মিথ্যা মামলায় নিরীহ মানুষকে হয়রানি ও রাতারাতি ভূঁয়া ওয়ারেন্ট বের করার নজির নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিক পরিচয়ে ‘ডাইল মানস’ সিন্ডিকেট এসব কারসাজিতে জড়িত বলে জানাগেছে। ‘ডাইল মানসের’ সঙ্গে আদালত পাড়ার কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশও রয়েছে। তিনি কখনো কখনো নিজেকে আইনজীবী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাও পরিচয় দেন। এসব অপকর্মের কারণে ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের অফিস এলাকায় তাকে গণপিটুনিও দেন ভুক্তভোগীরা।

‘ডাইল মানস’ চট্টগ্রাম আদালত পাড়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরঘুর করেন মক্কেলের খোঁজে। এ সময় তাকে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে খোশগল্প করতে দেখা যায়। তার সিন্ডিকেটের এক নারীকে দিয়ে ঢাকার দুই সিনিয়র সাংবাদিককে সাজানো মামলায় জড়ানোরও অভিযোগ রয়েছে। ওই গায়েবি মামলায় একজন জাতীয় একটি দৈনিকের সম্পাদক ও আরেকজন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা। মামলার পর থেকে আর বাদিকে খুঁজে পায়নি খোদ পুলিশও। পরে আদালতে তা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় মামলাটি খারিজ করে নথিজাত করেন আদালত।

এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে ওঠে আসে মিথ্যা মামলার বিষয়টি। এতে উঠে আসে চান্দগাঁও এলাকার কথিত যুবলীগ নেতা জসিম উদ্দিনের নাম। তিনি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার অন্নপূর্ণ বাড়ী গৈয়া মোহাম্মদের বাড়ীর শামসুল আলমের ছেলে। তিনি বর্তমানে নগরের চান্দগাঁও থানার রাহাত্তারপুল এক কিলোমিটার এলাকায় থাকেন।

এদিকে স্ত্রীর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিতে ভবন নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে সাবেক দুদক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ রোষানলে পড়েন কথিত সেই যুবলীগ নেতা জসিম উদ্দিনের। তিনি অর্ধকোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন শহিদুল্লাহর কাছ থেকে। টাকা না দিলে ফ্ল্যাট দাবি করেন।

জমি সংক্রান্ত এ ঘটনায় বেশ কয়েকবার সাবেক এ দুদক কর্কর্তার বাড়িতে দলবল নিয়ে হামলাও চালায় জসিম। কিন্তু এসবে কোননো সুবিধা করতে না পেরে মিথ্যা নাটক সাজিয়ে বাঁশাখালির এক অসহায় নারীকে ব্যবহার করে মিথ্যা মামলা দায়ের করান।

সেই মামলার বাদি রণি আক্তার তানিয়া জানান, আগস্টের মাঝামাঝি সময় তিনি বিনামূল্যে ঘরসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা পান জসিমের কাছ থেকে। পরে শহিদুল্লাহর নতুন তৈরী করা ভাড়াঘরে তাদের তুলে দেন জসিম। তাদের সেই ঘরে তোলার আগে দলবল নিয়ে শহিদুল্লাহর ভাড়াঘরে হামলা চালায় জসিম।

সেই ঘটনায় গত ১৮ আগস্ট নগরের চান্দগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন শহিদুল্লাহ। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হন রণি আক্তার তানিয়া ও তার স্বামী সোহেলসহ মো. শাহীন, মো. লিটন, রায়হান, কলি আক্তার।

সেই মামলায় জসিম উদ্দিনসহ ৬ নম্বর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডের মোজাহের উল্লাহ মুহুরীর বাড়ির মৃত ফিরোজ বকতের ছেলে জসিম উদ্দিন (৬৫), তার মেয়ে নুসরাত তাসু (২৩), মৃত জালাল উদ্দিনের ছেলে মো. শাহজাহান (৪৭), মৃত জামাল উদ্দিনের ছেলে মো. শাহিন (৪৫), মৃত এসএম শফি ছেলে মো. লিটন (৪৭), তার ভাই এস এম মান্নান (৪২), মো. ফরিদ উদ্দিনের ছেলে মো. রিফাত (৩৮), মোছা. বানু (৪৭) এবং অজ্ঞাতনামা ৪ থেকে ৫ জনকে আসামি করা হয়।

চারদিন কারাগারে থাকার পর তাদের জামিনে মুক্ত করেন জসিম। ফিরে এসে নিজেদের ঘরে আসবাবপত্র না থাকায় সেসব জিনিসের জন্য শহিদুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেন জসিম।

তার কথায় রাজি না হওয়ায় এক আইনজীবীর সহায়তায় বসে আনা হয় তানিয়াকে। মামলার আর্জি তৈরি করে তা মুখস্ত করানো হয় তাকে। বিচারকের সামনে তা বলতে বলেন। মামলার পর শহীদুল্লাহকে ঠেকাতে ও মান ক্ষুন্ন করতে তৎপর হয়ে পড়ে জসিমরা।

সেই মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, তানিয়া শহিদুল্লাহর বাসার গৃহকর্মী হিসাবে ৩ হাজার টাকায় কাজ করতেন। কাজের বেতন বাবদ তিনি সাড়ে ৬ হাজার টাকা পাওনা হন। ১২ আগস্ট ওই টাকা আনতে গেলে শহিদুল্লাহ বলেন, তোমাকে ভবনের নিচে একটি রুম ঠিক করে দেব। তখন আর ভাড়া দিতে হবে না এবং বকেয়া টাকাও পরিশোধ করে দেবেন। এরপর ২৩ আগস্ট রাতে বকেয়া টাকা চাইতে গেলে শহিদুল্লাহ তাকে গলা টিপে ধরেন। মারধর করেন। তার সঙ্গে থাকা কলি আক্তার নামে এক মহিলাকেও লাথি মারেন।

তবে নিজের ঘরের আসবাবপত্র না পাওয়ায় আইনজীবী তানিয়াকে আদালতে যেতে বললে তিনি যাননি বলে জানান।

এর আগে গত ৫ জুলাই দুপুরে ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অবৈধভাবে ওই জমি দখলে নিতে কথিত যুবলীগ নেতা জসিমের নির্দেশে হামলা চালান তার পরিবারের লোকজন। এ সময় সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করে সেখানে নিজের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন। শহীদুল্লাহর ভাড়া দেওয়া দোকানে হামলা চালিয়ে নগদ টাকা ও মালামাল লুটপাট করা হয়। পরে শহীদুল্লাহর ভাড়া দেওয়া ঘর থেকে ভাড়াটিয়া বের করে তালা ঝুলিয়ে দেন জসিম। ভাড়াটিয়া ফিরে আসলে তাদের হত্যার হুমকিও দেন।

এদিকে পুলিশ হেফাজতে সাবেক দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উপপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহিদুল্লার মৃত্যুর পর এএসআই মো. ইউসুফ আলী ও এটিএম সোহেল রানাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

আরএস/এফএমও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!