চট্টগ্রামের ৬ সংস্থার বাড়তি টাকা যাবে সরকারি কোষাগারে, সারা দেশে ৫৫

দেশের ৬১টি স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও স্ব-শাসিত সংস্থার ব্যাংকে থাকা উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। এর মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ছয়টি। এগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম ওয়াসা, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।

বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার বিধানকে আইন করার প্রস্তাব জাতীয় সংসদে তীব্র বিরোধিতার মুখে পাস হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় মেটাতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিলটি পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। তবে বিলটি পাসে তীব্র বিরোধিতা করেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা। তীব্র বাদানুবাদের মধ্যে বিলটি পাস হওয়ার পর ওয়াকআউট করে প্রতিবাদ জানায় বিএনপি। অন্যদিকে ওয়াকআউট না করলেও বিলটি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী যখন ভোটে দেন, তখন প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা ‘না’ ভোট দেন। ‘কালো আইন’ আখ্যা দিয়ে বিলটি নিয়ে নিজেদের দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাবগুলো প্রত্যাহার করে নেন তারা।

সরকারের ব্যাংক ঋণের ভার বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রের স্বশাসিত সংস্থাগুলোর কাছে থাকা ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে নেওয়ার পরিকল্পনা থেকে এই আইনটি করার উদ্যোগ নেয় সরকার।

৬১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা, যাদের উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাবে
জাতীয় কারিকুলাম এবং টেক্সটবুক বোর্ড, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, দিনাজপুর উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), পল্লী উন্নয়ন একাডেমি-বগুড়া, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষা ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বার্ক), জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সেরিকালচার বোর্ড, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ), বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি), বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ চা বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), চট্টগ্রাম ওয়াসা, ঢাকা ওয়াসা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন।

বিরোধীদলের তীব্র বিরোধিতা
বিলের উপর আলোচনায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশে শিপিং কর্পোরেশনের উদাহরণ দিয়ে জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘এখন এর টাকা নিতে হলে শেয়ার হোল্ডারদের অনুমতি নিতে হবে। এটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান।’

বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, ‘আর্থিক খাতে লুটপাটের কারণে এখন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর অর্থের দিকে চোখ পড়েছে সরকারের। সরকার রাজস্ব থেকে কেন উন্নয়ন করতে পারে না? শেয়ার বাজার লুট, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ, প্রকল্পের নামে সীমাহীন লুটপাট হচ্ছে। টাকা ব্যাংকে আছে। সেই টাকা নিয়ে নিলে শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ব্যাংকের হাতে টাকা থাকবে না। সরকারের এখন চোখ গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের দিকে।’

জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, ‘ক’দিন পরে আমার একাউন্টের টাকা নিয়ে নেবে কি না, সেই ভয়ে আছি। টাকা এখন ব্যাংক থেকে নিয়ে বাসায় নিয়ে যাবে কি না, ভাবছি।’

বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, ‘এটা একটা কালো আইন। আইন করে সমস্ত টাকা তুলে নেবে। উন্নয়নের জন্য অর্থ দরকার আছে। কিন্তু সামর্থ্য কতটুকু? এই টাকাগুলো ব্যাংকে জমা আছে। টাকা নেওয়া হলে ব্যাংকগুলো মারাত্মক বিশৃঙ্খলায় পড়বে। প্রতিষ্ঠানগুলোর স্পৃহা ধ্বংস হয়ে যাবে। ক্ষমতার অতিরিক্ত প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ নেই। শেয়ার বাজার ধ্বংস করে ফেলেছি। আমি এই বিলটি প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানাব।’

জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, “বিলটি পাস হলে অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে যাবে। এই টাকার মালিক জনগণ। পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার করেন। ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়েছে, সেদিকে নজর দিন।”

জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘জনবিরোধী এ আইন পাস হলে সংসদের ইতিহাসে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটবে। ব্যাংক থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। দেখা যাবে সামনের বছর ১ লাখ কোটি টাকা নেবেন। এর কোনো শেষ নেই।’

বিরোধী সদস্যদের সমালোচনার জবাব দিতে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, ‘এত বক্তৃতা শুনতে ভালো লাগে নাই। আপনারা একসময় দায়িত্বে ছিলেন, কী কাজ করেছেন? পৃথিবীতে কোথায় কী হচ্ছে, জানা দরকার। বাংলাদেশ অন্য দেশের কাছে দৃষ্টান্ত। আপনারা বলছেন, ব্যাংক, শেয়ারবাজার সব খালি করে ফেলেছি। আপনাদের সময় পুঁজিবাজার কী ছিল? আপনাদের সময় ইনডেক্স কী ছিল? এবার সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা।’

দেশের অর্থনীতির কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘একমাত্র রপ্তানি বাণিজ্য নেগেটিভ। এটা ছাড়া একটি খাতও নেই আমরা পিছিয়ে আছি। সবাই মনে করে বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জেপি মর্গান সবাই মনে করে জিডিপি আট ভাগের কম হবে না।”

বিলের বিরোধিতাকারী উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য এক। পিছিয়ে পড়ে থাকা মানুষকে মূল স্রোতে নিয়ে আসা। যত বড় ব্যবসায়ী তত বেশি ট্যাক্স দিচ্ছে। আইন সেভাবেই সাজানো। এ ধরনের আইন নতুন নয়। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন দশম সংসদে পাস হয়েছে। সেখানে এ ধরনের কথা বলা হয়েছে। একাদশ সংসদে উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ আইনে একই ধরনের কথা বলা হয়েছে। সরকারের কোষাগারে অর্থ জমা না পড়লে শৃঙ্খলা আসবে না।

সিপি