চট্টগ্রামের পথে পথে মরণফাঁদ, দায় এড়ায় সিডিএ-সিটি কর্পোরেশন

বৃষ্টি হলেই রাস্তা ও নালা আলাদা করা যায় না

চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ বাদামতলী রাস্তার পাশেই ১০-১২ ফুট প্রশস্ত উন্মুক্ত নালা, গভীরতা প্রায় ২০ ফুটের মত। মামা ও নানার সঙ্গে চশমা কিনে বাড়ি ফেরার পথে সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাতে পা পিছলে সেই নালাতেই পড়েন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদিয়া। সেই নালা আবার গিয়ে মিশেছে শহরের সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে। নালায় পড়ার পর পানির স্রোতে সাদিয়াও গিয়ে পড়েন সেই সুয়ারেজ লাইনে। প্রায় ৫ ঘন্টা পর কয়েক টন বর্জ্য সরিয়ে ৭০ ফুট নিচে সুয়ারেজ লাইন থেকে সাদিয়াকে উদ্ধার করা হয়। এর এক মাস আগে একইভাবে উন্মুক্ত নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ।

দায় এড়ায় সিডিএ-সিটি কর্পোরেশন

শুধু মুরাদপুর কিংবা আগ্রাবাদ নয়— শহরজুড়েই জায়গায় জায়গায় এরকম মুখ খোলা নালার সংখ্যা অগণিত। বেশিরভাগ জায়গায় ফুটপাতের মাঝখান থেকে একটা স্ল্যাব গায়েব হয়ে গিয়ে এমন উন্মুক্ত নালার সংখ্যা বাড়িয়েছে অগণিত। ফুটপাত ধরে চলতে গিয়ে খেয়ালে-বেখেয়ালে প্রায়ই এসব জায়গায় পড়ে গিয়ে আহত হচ্ছেন লোকজন— যার অনেক ঘটনাই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। যেমন চট্টগ্রাম নগরীর এরকম মৃত্যুফাঁদে পড়ে গত জুন মাসেই দুজন ব্যক্তি নালায় পড়ে যান। প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়া সেই দুজনকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের টিম। এই অভিযানগুলোতেও অংশ নিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার এনামুল হক।

এদিকে আগ্রাবাদ ও মুরাদপুরে পর পর দুজনের এমন দুর্ভাগ্য নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করছে এসব খোলা মুখের নালা নিয়ে। তবে এক মাস আগে সালেহ আহমদের ঘটনার পর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএর জলাবদ্ধতা প্রকল্পের দায়িত্বশীলদের তরফ থেকে খোলামুখের এসব ড্রেন নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও মাস ঘুরতেই এবারের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে চট্টগ্রাম সিটির মেয়রের মুখে শোনা গেল উল্টো সুর। দুর্ঘটনাস্থলে নালার মুখে নিরাপত্তা বেস্টনী না থাকার জন্য এবারে সিডিএকেই দুষলেন তিনি।

সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলছেন, ‘দেওয়ানহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যে কাজ চলছে, এর মেইনটেন্যান্স থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এখানে বড় বড় গর্ত হয়েছে। পানিতে রাস্তা এবং নালা এক হয়ে গেছে। খুঁটি গেড়ে লাল পতাকা টানিয়ে দিলেও মানুষ সতর্ক হতে পারতো। এখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ যারা করছে, তাদের অবহেলা আছে।’

অন্যদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বরাবরের মতই নীরব। এই সংস্থাটির চেয়ারম্যান বা পদস্থ কর্মকর্তারা কখনও মুখ খুললেও বিভিন্ন ঘটনায় দায় সিটি কর্পোরেশনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা দায় সারেন।

চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের এমন পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ও দায় এড়ানোর খেলায় নালার মুখ সুরক্ষিত করার বিষয়টি নিয়ে তো বটেই, জনজীবনে চলমান আরও নানা দুর্ভোগ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে নাগরিকদের মধ্যে।

নালা যেভাবে মরণফাঁদ

চট্টগ্রাম নগরীর নালাগুলো কেমন করে মরণফাঁদে পরিণত হল, তার খানিকটা আঁচ পাওয়া যায় ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেনের কথায়। আইআইইউসি ছাত্রী সাদিয়ার লাশ উদ্ধারের নেপথ্য কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সড়কের নিচে একটা নালা, প্রায় ১০ ফুট প্রশস্ত। আবার এর ভেতরে আরেকটা নালা পাওয়া যায়, সেটাও ৮ থেকে ১০ ফুট প্রশস্ত। সম্ভবত ৫০-৬০ বছর আগে সড়ক উঁচু করার সময় অপরিকল্পিতভাবে সেই নালা রেখেই আরেকটি নালা করা হয়। আগের সেই নালা ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ। কমপক্ষে সেখানে তিন টন আবর্জনা জমে আছে। অনেক চেষ্টা করেও ডুবুরি সেখানে যেতে পারেনি। সেটা আবার টার্ন নিয়েছে কর্ণফুলী নদীর দিকে দক্ষিণে। এরপর দুই ক্রেন মিলে আমরা সেই নালার স্ল্যাব উঠিয়ে এক টনের মতো আবর্জনা-মাটি অপসারণ করি। তখন আগের সেই নালার মধ্যে, কমপক্ষে সড়ক থেকে ৭০ ফুট গভীরে হবে, সেখানে আবর্জনায় আটকে আছে। সব মিলিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা চেষ্টার পর আমরা লাশ উদ্ধার করি।’

চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আগ্রাবাদ শাখার সিনিয়র স্টেশন অফিসার এনামুল হক বিবিসিকে বলেছেন, চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে শাখা নালাগুলো বেশ প্রশস্ত এবং উন্মুক্ত। এই নালাগুলো রাস্তা থেকে বেশ গভীর, বর্জ্যে ঠাসা। একই সঙ্গে এগুলো গিয়ে মিশেছে মূল নালার সঙ্গে— যা প্রধান সড়কের নিচে। সুতরাং এখানে কেউ পড়লে বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা থেকে যায়। চট্টগ্রামে যখন বৃষ্টি হয় তখন রাস্তা এবং নালাগুলো আলাদা করা যায় না।’

উন্নয়নের নামে মৃত্যুকূপ

পর পর মর্মন্তুদ এসব ঘটনার জন্য অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পকে দায়ী করে এর সাথে সংশ্লিষ্টদের বিচারের দাবিও তুলছেন কেউ কেউ। উন্নয়নের নামে চট্টগ্রামকে যুদ্ধবিধ্বস্ত নগর কিংবা মৃত্যুকূপ বানানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করছেন নাগরিকরা।

নগর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল আজিম রনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় এসব ঘটনায় দায়ী ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে মামলা করার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম ওয়াসার যে সকল ঠিকাদার কিংবা প্রকৌশলী অথবা দায়িত্বরত ব্যক্তির কর্তব্য অবহেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হোক।’

ফেসবুকে দেওয়া ওই পোস্টে রনি আরও লিখেছেন, ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আড়ালে দীর্ঘ ৫-৭ বছর যারা নগরীকে মৃত্যুকূপ বানিয়েছে, তারাও এ দায় এড়াতে পারে না।’

তবে রনি শুধু ঠিকাদার-প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে মামলার দাবি করে থামলেও সেখানেই থামাতে আপত্তি আছে নাগরিকদের। মাকসুদুল করিম নামে একজন রনির পোস্টেই প্রশ্ন তুলেছেন— ‘সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, মেয়র, সিডিএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কেন মামলা হবে না? তাদের দায়মুক্তি কে দিল?’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!