করোনার ঝুঁকি নিয়ে রাঙ্গুনিয়ার শতাধিক ইটভাটায় হাজারো শ্রমিক

মানা হচ্ছেনা স্বাস্থ্যবিধি, প্রশাসনের নেই নজরদারি

লক্ষীপুর থেকে আসা আজাহারুল ইসলাম (৫২) চোখ-মুখে বিষণ্ণতা আর আতঙ্ক নিয়ে ইটভাটায় কাজ করছেন। তার এ আতঙ্কের কারণ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। তার রয়েছে পরিবারের সদস্যদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার দুশ্চিন্তাও।

তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন- ‘করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমি কিছুই বুঝি না, তবে বাড়িতে থাকার কথা শুনেছি। কিন্তু ছুটি না দিলে তো বাড়িতে যেতে পারছি না। চাকরি চলে গেলেও পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়বো। আর দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে চেষ্টা করি, কিন্তু পারিনা। কাজ করতে গেলে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়েই যায়। খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানোও একসঙ্গে করতে হয় আমাদের।’

তার মতো একই অবস্থা ভাটা শ্রমিক সৈয়দুল হক, কুদ্দুস সহ রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১১০ ইটভাটার হাজার হাজার শ্রমিকের। শনিবার (১৭ এপ্রিল) সরেজমিনে উপজেলার কয়েকটি ইটভাটায় দল বেঁধে কাজ করতে দেখা যায় ভাটা শ্রমিকদের।

জানা যায়-করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে রাঙ্গুনিয়াতেও চলছে অঘোষিত লকডাউন। বন্ধ সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও মিল-কারখানা। তবে ব্যতিক্রম শুধু চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ইটভাটাগুলোতে। এখনও বন্ধ হয়নি উপজেলার কোন ইটভাটা। পুরাদমে চলছে ইট পোড়ানোর কাজ। করোনার তীব্র ঝুঁকি নিয়েই ভাটায় কাজ করছেন প্রায় ১৫-১৬ হাজার শ্রমিক।

এদিকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার সচেতন করা হলেও তাতে কর্ণপাত করছেনা ভাটার মালিকরা। বরং শ্রমিকদের চাপ প্রয়োগ করেই কাজ করাচ্ছেন তারা। তবে ভাটা মালিকদের দাবি-শ্রমিকদের চাপেই ইটভাটা চালু রাখতে হচ্ছে।

জানা যায়, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে উপজেলা প্রশাসন ওষুধ আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া সব অফিস, প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট বন্ধ রাখলেও রাঙ্গুনিয়ার প্রায় ১১০ ইটভাটায় এখনও ইট পোড়ানোর কার্যক্রম চালু রয়েছে।

ইটভাটার মালিকরা অনকেটা শ্রমিকদের জিম্মি করেই এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এসব ভাটায় সুরক্ষা ছাড়া প্রায় ১৫-১৬ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। বেশিরভাগ ভাটায় মানা হচ্ছেনা স্বাস্থ্যবিধি। এতে দ্রুত বাড়ছে করোনাভাইরাসের মারাত্মক ঝুঁকি। অথচ স্থানীয় প্রসাশনের সেদিকে কোন নজরদারি নেই।

অপরদিকে নোয়াখালী, লক্ষিপুর থেকে আসা শ্রমিকদের কাজে নিয়োজিত করায় করোনা আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিনে উপজেলার রাজানগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, বিএনবি, বিএসবি, এবিএম, এমবি ডাব্লিউ, এসএসবি-২, বিবিএম, বিকেবি, বিআরবি-২, ও বিবিসি-১ ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজ চলছে।

প্রত্যোকটি ভাটার শ্রমিকেরা জড়ো হয়ে ঘা ঘেঁষাঘেঁষি করেই বালি মিশ্রিত কাঁদামাটি দিয়ে ইট তৈরীর কাজ করছেন। অথচ নেই কোন করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধক মাস্ক (মুখোশ), নেই পর্যাপ্ত সাবান ও হ্যান্ড সেনিটাইজারের ব্যবস্থা।

শ্রমিকদের থাকার ঘরগুলোর অবস্থা একেবারেই নাজুক। ছোট ছোট ঝুঁপড়ির ভাঙাচোরা একেকটা ঘরে একত্রে জড়ো হয়ে ৩০-৪০ জন শ্রমিককে গাদাগাদি করে থাকতে দেখা যায়।

এবিএম ভাটার মাঝি সৈয়দুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের ঝুঁকি আছে জানি। কি করব ভাটার মালিক আমাদের কাজ করতে বাধ্য করেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের নিয়ে পরিবার অনেক চিন্তায় রয়েছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসলামপুরের এক ভাটার মালিক বলেন, ‘ইটভাটা বন্ধে সরকার থেকে কোনো দিক-নির্দেশনা পায়নি। ভাটা বন্ধে উপজেলা প্রশাসন থেকেও আমাদেরকে কোন চিঠি দেয়নি বিধায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া মৌসুম শেষ, কয়দিন পরই বৃষ্টি শুরু হবে। এখনো অনেক কাঁচা ইট পোড়ানো বাকি রয়েছে। এই মুহূর্তে শ্রমিকদের ছেড়ে দিলে আমাদের বড় ক্ষতি হবে।’

রাঙ্গুনিয়া ইটভাটা মালিক সমিতির সেক্রেটারি কামাল উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখন ইটভাটা বন্ধ করে দিলে অনেক লোকসান গুনতে হবে। এমনিতেই কয়লা সংকটের কারণে এবার ইট পোড়ানো শুরু করতে দেরি হয়েছে। এখনো প্রতিটি ভাটায় অনেক কাঁচা ইট রয়েছে। তবে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজ করানো হচ্ছে।’

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাজিব পালিত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যেখানেই গ্যাদারিং বা জনসমাগম হয়, সেখানেই করোনাভাইরাস ছড়ানোর ভয় সবচেয়ে বেশি। আমরা আসলেই জানিনা ভাইরাসটি কার ভিতরে আছে। আর ইটভাটায় ধূলাবালি উড়ে বেশি এবং শ্রমিকরা দূরত্ব বজায় না রেখে কাজ করে। তাই ইটভাটার শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।’

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘সরাকরি নির্দেশনামতে এখন কোনো ইটভাটা চলবেনা। ইটভাটাগুলো জরুরি সেবা নয়। করোনার এই দুর্যোগ মোকাবিলায় ইতোমধ্যে ইটভাটা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদি কেউ ইটভাটা চালু রাখে তাহলে প্রয়োজনে ভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এসএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!