আপসে বিরোধ মীমাংসায় মডেল রাঙামাটি, আশা জাগাচ্ছে লিগাল এইড

১ বছরে ১২০৫ নালিশের ১০৯৫টিই নিষ্পত্তি

পার্বত্য রাঙামাটিতে ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত মামলার অধিকাংশ মামলা আসে বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে। উপজেলার উগলছড়ি গ্রামের বাছনি খাতুনের ৩৬ শতক জায়গা বেদখল করার চেষ্টা হয়েছিল ভুয়া দলিলে। দুই বছর ধরে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু বাছনি খাতুন সমাধান পেয়েছেন ভিন্ন উপায়ে। জেলা লিগ্যাল এইড বা জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার কার্যালয় শেষমেশ সমাধান করেছে তার এই সমস্যা।

রাঙামাটি জেলা শহরের রেডিও সেন্টার এলাকার বিপরীতে ৫০ শতক জমি রয়েছে আমির আলীর। ২০২২ সালে পার্শ্ববর্তী আজগর আলীসহ চার প্রতিবেশী তার বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সাতবার সরেজমিন ও ছয়বার বিরোধপূর্ণ ভূমির পরিমাপ হয়। এছাড়া প্রতিপক্ষের কাছ থেকে নানা হুমকিও পেয়েছেন তিনি। অবশেষে রাঙামাটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ মো. জুনাইদের পদক্ষেপে এই মামলার সুরাহা হয়। বর্তমানে প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছেন তিনি।

শুধু বাঘাইছড়ি উপজেলার বাছনী খাতুন বা শহরের আমির আলী নন, রাঙামাটি জেলার অন্তত সাড়ে তিন শতাধিক বিচারপ্রার্থী মামলা না করে আপসের মাধ্যমে বিচার পেয়েছেন। এতে আদালতে মামলার সংখ্যা কমছে। পাশাপাশি দ্রুত সুবিচার পাচ্ছেন বিচারপ্রার্থী ব্যক্তিরা।

বাছনী খাতুন বলেন, ‘আমি গরিব বলে কিছু লোক জায়গার মালিকানা দাবি করে ভুয়া দলিল তৈরি করে। তারা জায়গা দখলের চেষ্টাও করে। নিরুপায় হয়ে দুই বছর ধরে প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি। লিগ্যাল এইডের জজ সাহেব চার মাসের মধ্যে আমাকে সুবিচার দিয়েছেন।’

রাঙামাটি সদর উপজেলার রাঙাপানি মৌজার মৃত আহাম্মদ কবীরের স্ত্রী ছালমা বেগম (৭৩)। পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে নিজেদের মত সংসার করলেও বৃদ্ধা মায়ের খোঁজ নেয় না তিন ছেলে-মেয়ের কেউই। নিরুপায় হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন ছালমা বেগম। পিতা-মাতার ভরণপোষণে আইনে মামলা করেন তিন ছেলের বিরুদ্ধে। গত বছরের ২৩ অক্টোবর রাঙামাটির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে মামলাটি রেকর্ডভুক্ত হয়। আদালত মামলা আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন। লিগ্যাল এইড অফিস প্যানেল আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে ছালমা বেগমের অধিকারের জন্য লড়ছেন।

জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাঙামাটি লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে ১ হাজার ২০৫টি আবেদন জমা পড়ে। তার মধ্যে ১ হাজার ৯৫টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। বিরোধ আপসের ফলে ১ কোটি ২২ লাখ ৪ হাজার ৯৪ টাকা টাকা আদায় হয়েছে।

এছাড়া ৪২০টি দেওয়ানি, ফৌজদারি ও পারিবারিক মামলা মীমাংসা হয়েছে। মামলা মীমাংসা হার ৩৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আইনি পরামর্শ পেয়েছেন ১ হাজার ১৭৫ জন। আদালতে বিচারাধীন ১০১টি আপসে মীমাংসার ফলে প্রত্যাহার হয়েছে।

রাঙামাটি লিগ্যাল এইড অফিসের অন্যতম উদ্যোগ হলো বিরোধপূর্ণ জমিতে গিয়ে মীমাংসা বৈঠক। এটি সারাদেশের প্রথম ধাপে রাঙামাটিতেই শুরু হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ অঞ্চল হওয়ায় এ কার্যক্রমের আওতায় ১৪৫টির অধিক বিরোধপূর্ণ জমিতে গিয়ে মীমাংসা বৈঠক করা হয়েছে।

রাঙামাটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ মো. জুনাইদ বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে রাঙামাটি লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২২ সালের শুরুর দিকে এখানে যোগদান করি। আমরা সাধারণত তিনটি ধাপে কাজ করে থাকি। প্রথমত মানুষকে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা প্রদান; দ্বিতীয়ত আপসে বিরোধ নিষ্পত্তি; তৃতীয়ত জমি বিরোধ, পারিবারিক বিরোধ ও ভরণপোষণ সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলা মীমাংসা।’

তিনি বলেন, ‘রাঙামাটিতে ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি একটি জটিল কাজ। সাম্প্রতিক কোনো জরিপ না থাকায় প্রায়ই এ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে আমরা সরাসরি বিবাদমান স্থানে গিয়ে উভয়পক্ষের সম্মতিতে সমাধান করি। গত এক বছরে অন্তত দেড়শ ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি করেছে রাঙামাটি জেলা লিগ্যাল এইড। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলায় পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি আদালত না থাকতায় লিগ্যাল এইড এই বিরোধ নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’

লিগ্যাল এইডের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালিমা ওয়াহিদা জেনী বলেন, ‘লিগ্যাল এইড রাঙামাটির দরিদ্র ও অসহায় বিচারপ্রার্থীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। সার্ভিসের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ পারিবারিক বিরোধ, জমিজমার বিরোধ নিষ্পত্তিসহ নানাভাবে সুফলভোগী হচ্ছেন। আমরা লিগ্যাল এইডের প্যানেল আইনজীবী হিসাবে এই সেবা দিয়ে যাচ্ছি।’

জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাঙামাটিতে লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম দৃষ্টান্তমূলক। জনসাধারণের আপসে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এর চেয়ে বিকল্প আর নেই।’

তবে নিজেদের প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ মো. জুনাইদ বলেন, ‘আমাদের যাতায়াতের কোনো যানবাহন নেই। পর্যাপ্ত জনবলের সংকট রয়েছে।’

‘সার্ভেয়ারসহ যদি জনবল সংকট ও পরিবহন সংকট নিরসন হয়, সেক্ষেত্রে আমরা বিচারপ্রার্থীদের জন্য আরও বেশি পরিমাণে কাজ করতে পারব’— যোগ করেন তিনি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!