অবশেষে চট্টগ্রামের সেই বৃদ্ধ প্রবাসী পরিবার খুঁজে পেলেন, বিমানবন্দরে আবেগে ভাসলো সবাই

২৫ বছর পর দেশে ফিরে চট্টগ্রামের বৃদ্ধ সেই প্রবাসী অবশেষে পরিবার খুঁজে পেলেন। চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকার বাসিন্দা ওই প্রবাসীর ছেলে তার বাবাকে শনাক্ত করেন। এরপর চট্টগ্রামের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটনের সহায়তায় হালিশহর এলাকায় বসবাসকারী পরিবারের সন্ধান মেলে। চট্টগ্রাম থেকে বুধবার (১৮ জানুয়ারি) ওই প্রবাসীর ছেলে-মেয়েরা ঢাকায় গিয়ে পৌঁছান। এরপর বিকেলে আবুল কাশেম নামের ওই বৃদ্ধকে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান।

অবশেষে চট্টগ্রামের সেই বৃদ্ধ প্রবাসী পরিবার খুঁজে পেলেন, বিমানবন্দরে আবেগে ভাসলো সবাই 1

দীর্ঘ ২৫ বছর পর বাবার সঙ্গে সন্তানদের দেখা হলো এই প্রথম। ২৫ বছর আগে আবুল কাশেম যখন সৌদি আরবে যান, তখন তার ছোট মেয়ে রুমা মায়ের পেটে। সেই রুমাও ঢাকা গিয়ে বাবাকে চট্টগ্রাম নিয়ে আসতে গিয়েছেন।

অবশেষে চট্টগ্রামের সেই বৃদ্ধ প্রবাসী পরিবার খুঁজে পেলেন, বিমানবন্দরে আবেগে ভাসলো সবাই 2

দীর্ঘদিন পর পরিবারকে পেয়ে আবুল কাশেম তার সন্তানদের বারবার জড়িয়ে ধরছিলেন। তাকে নিতে ঢাকার যাওয়া মেয়ে পারভীন আক্তার বলেন, আমার বাবা যখন ২৫ বছর আগে সৌদি আরবে যায় আমার ছোট বোন রুমা তখন মায়ের পেটে। বাবার সঙ্গে আমাদের স্মৃতি খুব কম। আমরা এখন বাবাকে ফেরত পেলাম। আমাদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।’

অবশেষে চট্টগ্রামের সেই বৃদ্ধ প্রবাসী পরিবার খুঁজে পেলেন, বিমানবন্দরে আবেগে ভাসলো সবাই 3

এর আগে ২৫ বছর পর সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আবুল কাশেম নামের এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাকে দিন কাটাতে হয়েছে এনজিও ব্র্যাক আশ্রয়ে। বৃদ্ধ ওই রেমিট্যান্স যোদ্ধার পরিবারের কোনো খোঁজ মিলছিল না। বৃদ্ধের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার নাম জানা যায়, আবুল কাশেম। তিনি কখনও ঠিকানা বলছেন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট। আবার কখনও বলেছেন কখনও হালিশহর, কখনওবা আবার রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের শংকরহাট, রাউজান। তার ৬ মেয়ে ও ৩ ছেলে রয়েছে জানিয়ে বৃদ্ধ বলেছিলেন, তার তিন ছেলের নাম মান্নান, নূর হাসান ও এনামুল হাসান।

ঢাকা বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স যোদ্ধা আবুল কাশেম শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে সৌদি আরব থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফেরেন। এরপর বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ওই কর্মীর পরিবারের সন্ধান ও তাকে নিরাপদে হস্তান্তর করার জন্য ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে হস্তান্তর করে।

রোববার (১৫ জানুয়ারি) বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন এন্ড ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভ প্রোগ্রাম হেড শরিফুল হাসান ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে বৃদ্ধের পরিবারের খোঁজ চেয়ে জানান, ‘আমরা তাঁর বাড়ি কোথায় নিশ্চিত হতে না পারলেও ভাষা শুনে এটুকু বুঝতে পারছি তার বাড়ি চট্টগ্রাম অঞ্চলে। তার কাছে কোন পাসপোর্ট ছিল না। কাজেই সঠিক কোন ঠিকানাও পাওয়া যায়নি। তিনি ট্রাভেল পাস নিয়ে এসেছেন। প্রায়ই এভাবে লোকজন আসে। আমাদের অবজারভেশন হলো, সম্ভবত তাঁর ডিমেনশিয়া আছে। উনার শারীরিক অবস্থাও কথা বলার মত না, আধো আধো ভাষায় কথা বলেন। প্রায় ২৫ বছর পর তিনি সম্ভবত বাংলাদেশে এসেছেন।’’

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান জানান, বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশসহ সবার সহযোগিতায় বিদেশফেরতদের জন্য আমরা নানান ধরনের সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। এরই অংশ হিসেবে বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটি ও মাইগ্রেশন পুলিশ শনিবার (১৪ জানুয়ারি) বিকেলে ওই বৃদ্ধকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে দেন। ইমিগ্রেশন পুলিশের তথ্যানুযায়ী এই বৃদ্ধ সম্ভবত শুক্রবার রাতে জেদ্দা থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছেন। তার কাছে কোনো পাসপোর্ট ছিল না। তিনি ট্রাভেল পাস নিয়ে এসেছেন।

শরিফুল হাসান জানান, শারীরিকভাবে সুস্থ মনে হলেও সম্ভবত তিনি ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত। এ কারণেই তিনি সঠিকভাবে তার ঠিকানা বলতে পারছেন না। তিনি জানাচ্ছেন তার নাম আবুল কাশেম। বাবার নাম ফজেল আহমেদ, মায়ের নাম সাবানা। স্ত্রীর নাম বলছেন আমেনা। নিজের ঠিকানা তিনি কখনও বলছেন চট্টগ্রামের নয়াবাজার। কখনও বলছেন টেকনাফ। আবার কখনও রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের গরিশংকরহাটের কথাও বলছেন। আবার বলছেন, চট্টগ্রামের নতুন বাজার হালিশহরের কাছে, ঈদগাহের মাঠ বউ বাজার এলাকায় তার ছেলের তরকারির দোকান আছে। আমরা তার বাড়ি কোথায় নিশ্চিত হতে না পারলেও ভাষা শুনে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম তার বাড়ি চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

শরিফুল হাসান জানান, যেহেতু তিনি চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলছিলেন কাজেই আমরা চট্টগ্রামের পুলিশসহ নানা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা তার পরিবারের সন্ধানে গণমাধ্যমকর্মীদের সহায়তা চাই। অনেকেই তার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন। এরপরও আমরা পরিবারের সন্ধান পাচ্ছিলাম না।

শরিফুল হাসান জানান, ওই বৃদ্ধ কখনও চট্টগ্রামের হালিশহর, কখনও হাটহাজারী, নয়াবাজারসহ বেশ কিছু ঠিকানা বলছিলেন। তিনি যখন যেসব এলাকার কথা বলছিলেন আমাদের চট্টগ্রামের ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মীরা সেসব এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন। ওই বৃদ্ধ বলছিলেন চট্টগ্রামের নয়াবাজার এলাকায় তার ছেলে তরকারি বিক্রি করে। সেই কথার ওপর ভিত্তি করে আমাদের চট্টগ্রাম টিম ‘পরিবারের সন্ধান চাই’ শিরোনামে ছবিসহ শত শত পোস্টার বিলি করে বেড়ায়। চট্টগ্রামের শহরের হালিশহর, নয়াবাজার, বউবাজার, ঈদগাহ, পাহাড়তলীসহ আরও বেশ কয়েকটি স্থানে দেয়ালে দেয়ালে আমরা পোস্টার লাগানো হয়। আমরা বিশ্বাস রেখেছিলাম গণমাধ্যমকর্মীসহ সবার সহযোগিতায় আমরা তার পরিবারকে খুঁজে বের করবোই।

শরিফুল হাসান জানান, এসব পোস্টার দেয়ালে লাগানো ও বিতরণ করার পর মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) বিকেলে চট্টগ্রামের আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র (২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর) আব্দুস সবুর লিটন যোগাযোগ করেন।

তিনি জানান, পোস্টারের ছবির লোকটিকে তিনি চিনতে পেরেছেন। এরপর আমাদের লোকজন তার অফিসে যায়। তার সহযোগিতায় আমরা তার ছেলে সবজি ব্যবসায়ী জনাব নূর হাসানের খোঁজ পাই। পরবর্তীতে কাউন্সিলর অফিসে তাকে এনে কথা বলে জানতে পারি আবুল কাশেম তার বাবা। তার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখেও আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। নুর হাসানের কাছ থেকে আমরা পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলি। দুবাইতে থাকা তার এক ছেলের সঙ্গেও কথা বলি। এরপর বৃদ্ধ আবুল কাশেমের ছোট মেয়ে রুমা বেগম ও তার স্ত্রী আমেনা বেগমের সঙ্গে ঢাকা থেকে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দেই। এ সময় যে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেটি ভাষায় বলা কঠিন। এরপরই আমাদের লোকজনের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা তাকে নিতে ঢাকায় রওয়ানা হন।

এদিকে বুধবার (১৮ জানুয়ারি) বিকেলে আবুল কাশেমকে তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার সময় ব্র্যাক কর্মকর্তারা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক স্কোয়াড্রন লিডার মো. রাসেল তালুকদার, সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল হান্নান রনি এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল আলম ।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিদেশ ফেরত আবুল কাশেমের বড় ছেলে নূর হাসান। বাবাকে ফিরে পেয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ব্র্যাকসহ আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। অনেক দিন ধরে বাবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। আমরা জানতাম না তিনি সৌদি আরবের কোথায় আছেন। তিনি যে দেশে এসেছেন সেটাও আমরা জানতাম না। পোস্টার দেখে ও স্থানীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্র্যাকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়। আমরা তার পরিবারের সদস্য হয়েও যা করতে পারিনি, ব্র্যাক আমার বাবার জন্য তার চেয়ে বেশি কিছু করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক বলেন, বাবা-সন্তানের দেখা হওয়ার যে দৃশ্য এটি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমরা অনেকদিন ধরে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সাথে কাজ করছি। এই প্রবাসীকেও আমরা মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ব্র্যাকের কাছে দিয়েছিলাম।

স্কোয়াড্রন লিডার মো. রাসেল তালুকদার বলেন, ২৫ বছর পর নিজ দেশে ফেরত এসেছেন এমন একজন অভিবাসীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। এমন ঘটনা আমরা সব সময় সিনেমাতেই দেখি, বাস্তবে এই প্রথম আমি ঘটনার সাক্ষী হলাম। বিমানবন্দরে এমন অনেক যাত্রীকেই আমরা পাই যারা মানসিক অসুস্থতার কারণে কিছুটা স্মৃতিভ্রম থাকে। তারা কোথায় যাবেন না যাবেন সেটা বুঝতে পারেনা। সেই সময়টাতে আমরা ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে যোগাযোগ করে নিশ্চিন্তে থাকি। করোনাকালীন সময়েও তারা এসব ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশফেরতদের পাশে ছিলেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!