ছোটবেলা থেকেই তিনি গানপাগল। বড় হয়ে মিউজিশিয়ান হবেন— এমন বাসনাও ছিল মনে। কিন্তু হয়ে গেলেন বিসিএস ক্যাডার। তাও বিসিএসে প্রথমবারেই বাজিমাত। ৩৮তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সারা দেশে সপ্তম স্থানটি দখলে নিয়েছেন চট্টগ্রামের ছেলে সায়েম ইমরান।
গানপাগল এই ছেলেটি স্কুলজীবন থেকেই একাধারে বিতর্ক বক্তৃতা, আবৃত্তি, রচনা প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমেও সরব থেকেছেন। সায়েম ইমরান বললেন, ‘শুধু বইয়ের পাতায় আটকে না থেকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকেও যখন যেভাবে পেরেছি জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করেছি। আমার কাজকর্মে বড় অনুপ্রেরণা আমার মা-বাবা। বাসায় পড়াশোনা নিয়ে মা-বাবা কখনোই চাপ দেননি। সব সময় বলতেন, সার্থক মানুষ হও। আজ বাবা-মায়ের দোয়ায় পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।’
চট্টগ্রামের পটিয়া পৌরসভার উত্তর গোবিন্দরখীল এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আলী মুন্সির বাড়ির বাসিন্দা বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পটিয়া উপজেলার ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর ও কামরুন নাহারের দুই ছেলের মধ্যে সায়েম ইমরান বড়। ছোট ভাই সাঈদ ইমরান সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম বিভাগে পাশ করেছেন।
সায়েম ইমরান ২০০৫ সালে কলেজিয়েট স্কুল থেকে এ-প্লাস পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। পঞ্চম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণিতে পেয়েছেন বৃত্তি। সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে ২০০৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিকেও পেয়েছেন এ-প্লাস। তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (২০০৮-২০০৯) শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে সেশনজটের কারণে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বের হন ২০১৭ সালে। পড়ালেখা শেষে ২০১৯ সালে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন। তবে ছোটবেলা থেকেই মনে পুষতেন মিউজিশিয়ান হবার বাসনা। তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি সমানে চালিয়ে গেছেন গানের চর্চা। কিন্তু এর মধ্যে অংশ নেন বিসিএস পরীক্ষায়। ৩৮তম বিসিএস ছিল তার জীবনের প্রথম বিসিএস। আর প্রথমবারেই সারাদেশে প্রশাসন ক্যাডারে সপ্তম স্থান অধিকার করলেন তিনি।
বিসিএস প্রস্তুতি বিষয়ে সায়েম ইমরান বলেন, ‘বিসিএস প্রস্তুতি নিতে গিয়ে শুরুতে কিছুটা হতাশ ছিলাম। এত বেশি পড়া, এত কম সময়ে কিভাবে সম্ভব? তাই শুরুতে হতাশ হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিই। কিছুদিন বিরতি দিয়ে চিন্তা করলাম, আমি কোন্ বিষয়ে ভালো পারি। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় বিজ্ঞান আর গণিতই আমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। ভাবলাম, এ দুই বিষয়ের প্রস্তুতি এমনভাবে নিতে হবে, যেন এখান থেকে একটা নম্বরও মিস না হয়। প্রিলিমিনারির জন্য বাজারের ভালোমানের এক সেট বই কিনে পড়াশোনা শুরু করলাম। গণিত ও বিজ্ঞানের সিলেবাস যখন শেষ করলাম, তখন বেশ আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। তারপর ধীরে ধীরে বাংলা, ইংরেজি, আন্তর্জাতিক বিষয়, বাংলাদেশ বিষয় সিলেবাস দেখে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। প্রতিটি সিলেবাস ভাগ করে নিলাম। টার্গেট নিতাম ছোট ছোট। যেমন আজকে ৩০ পৃষ্ঠা পড়বো। আবার ওই ৩০ পৃষ্ঠা খুব ভালোভাবে পড়ে নিজে নিজেই পরীক্ষা দিতাম। এভাবেই খুব অল্প সময়ে সিলেবাস শেষ করেছি। আর প্রচুর মডেল টেস্ট দিয়েছি। এটা খুব উপকারে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘ঘড়ি দেখে সময় ধরে মডেল টেস্ট দিতাম। দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত পড়েছি। পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা, আন্তর্জাতিক পাতা ও অর্থনীতির পাতায় সবসময় চোখ বুলাতাম। ফলে সাধারণ জ্ঞান ভালো আয়ত্ত্ব করতে পেরেছি। বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে অনেকবার মনে হয়েছে শুধু পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য নয়, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান এবং দেশ-বিদেশের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা রাখা উচিত। লিখিত পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয় পয়েন্ট আকারে লেখার চেষ্টা করেছি। সংবিধান ভালোমতো পড়ায় মোটামুটি সব জায়গায় এর উদ্ধৃতি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি।’
সায়েম বললেন, ‘আপনি যা জানেন তা যদি সঠিক হয় তাহলে সেটার ব্যবহার অবশ্যই করবেন এবং এমনভাবে করবেন, তা যেন পরীক্ষকের চোখে পড়ে। জীবনের প্রথম বিসিএসে ৩৮তম মেধাক্রম অর্জন করে প্রথম পছন্দ প্রশাসন ক্যাডারে আসতে পারা সত্যি আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।’
প্রশাসন ক্যাডারে সামনে যারা আসতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে সায়েম ইমরান বলেন, ‘জীবনে স্বপ্ন দেখলে আর সেই স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায় নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে হবে। তবেই সে স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায়। আমি আসলে সারাজীবনই পাবলিক রিলেশন নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি। মানুষকে সাহায্য করা বা মানুষের পাশে দাঁড়ানো সবসময়ই আমার মধ্যে খুব কাজ করতো। নিজের মত করে যতটুকু পজিটিভ থাকা যায় তার চেষ্টা সবসময় করেছি। আমার ইচ্ছাগুলো সৎ ছিল বলে আল্লাহ আমাকে আজকে এই সুযোগটা দিয়েছেন। আর মানুষকে সাহায্য করার জন্য যদি কোনও চাকরি থাকে, তাহলে প্রশাসনে তার সুযোগ সবচেয়ে বেশি বলে আমি মনে করি।’
ব্যক্তিগত জীবনে সায়েম ইমরান বিবাহিত। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাবিলা রহমানকে বিয়ে করে ঘরে তোলেন।
সায়েম ইমরান সম্পর্কে তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে বেশি পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি আমার। পড়েছি পটিয়া কলেজে আইএসসি পর্যন্ত। তাই সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। যাতে দেশ ও দশের খেদমত করতে পারে। সেই সুযোগ আমার ছেলে পেয়েছে। আমি আশা করবো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঁকড়ে ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত রাখবে।’
এসএ/সিপি