করোনাকালেই ১১৪ কোটি টাকা পাচার করা এক সরকারি কর্মকর্তার গল্প

অর্থবছরের প্রতি মাসেই সন্দেহজনক লেনদেন গড়ে ৩০৬টি

করোনা মহামারিতে বাংলাদেশ যখন স্থবির, চারদিকে যখন শুধুই আতঙ্ক ও অভাব অনটনের নিদারুণ গল্প— তখন উর্ধতন এক সরকারি কর্মকর্তা মেতে উঠেছিলেন টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উৎসবে। করোনার দুর্বিসহ সময়টাতেই ওই কর্মকর্তাকে দেখা গেছে, ৫২০ কোটিরও বেশি টাকার সন্দেহজনক ব্যাংক লেনদেন করতে। তার স্ত্রীর নামে করা একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেই সময় বড় একটি সরকারি টেন্ডারের কাজ পেয়েছিল।

টেন্ডারটি ছিল সরকারি হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে সার্জিক্যাল সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য। দেশেই শুধু নয়, চারটি দেশের ব্যাংকে তার নিজের এবং তার স্ত্রীর নামে খোলা একাউন্টেও লেনদেন চালাতে দেখা গেছে সরকারি ওই কর্মকর্তাকে। বাংলাদেশ থেকে ওইসব একাউন্টে করোনাকালেই পাচার করে দেওয়া হয়েছে ১১৪ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০১৯-২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য। বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনাভাইরাস সম্পর্কিত পণ্য আমদানি ও রপ্তানির নামে কিভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে বিপুল টাকা বেহাত ও দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে।

প্রতারকের নাম উল্লেখ না করে দুর্নীতিবাজ সেই সরকারি কর্মকর্তার একটি বিশেষ প্রতারণা মামলার প্রসঙ্গ টেনে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতিবেদনে নিশ্চিত করা হয়েছে, স্ত্রীর নামে খোলা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক একাউন্ট থেকে ১১৪ কোটি টাকা বিদেশে এমন এক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক একাউন্টে পাঠানো হয়েছে, যার মালিকের নাম আছে বিশ্বজুড়ে বহুল আলোচিত ‘পানামা পেপার্সে’।

২০১৬ সালে একদল সাংবাদিক বিশ্বজুড়ে কর ফাঁকি দেয়া অনেক বড়লোক এবং নামকরা রাজনীতিবিদের গোপন ব্যাংক একাউন্টের তথ্য প্রকাশ করে হইচই ফেলে দেন। এটি পরিচিত হয়ে ওঠে ‘পানামা পেপার্স’ নামে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি পানামা পেপার্সের পাবলিক ডকুমেন্টে বাংলাদেশের অন্তত ৫০ ব্যক্তি ও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম ওঠে আসে। যাতে রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও রয়েছে ব্যবসায়ীদের নাম।

বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই সরকারি কর্মকর্তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি স্ত্রীর নামে হলেও সেটি অনেকটা প্রকাশ্যেই চালাতেন ওই সরকারি কর্মকর্তা নিজে। তার স্ত্রী মূলত কোম্পানির সুবিধাভোগী।

গোয়েন্দা ইউনিটের তদন্তে জানা যায়, সরকারি কর্মকর্তা তার স্ত্রীর কোম্পানির পক্ষে পণ্য সরবরাহের জন্য ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতেন। তিনি বিশেষ বিশেষ সরকারি টেন্ডারও নিয়ন্ত্রণ করতেন স্ত্রীর কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য। দেখা গেছে, এমনকি ন্যূনতম সিকিউরিটি ডিপোজিট পরিশোধ না করেও তিনি বড় দরপত্র হাতিয়ে নিয়েছেন।

দেশেই শুধু নয়, গোয়েন্দা ইউনিটের তদন্তে দেখা গেছে গুণধর এই সরকারি কর্মকর্তা তার নামে অন্য একটি দেশেও গড়ে তুলেছেন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। অথচ সরকারি কর্মকর্তা তো নয়ই, কোনো বাংলাদেশিও নিয়ম অনুযায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারেন না।

অনুসন্ধানের পর দেখা গেল, ওই সরকারি কর্মকর্তা তার স্ত্রীর সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ। এরপর তিনি তার স্ত্রীর নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে সেই অবৈধ টাকা বৈধ করার চেষ্টা করে গেছেন। শেষ পর্যন্ত অবৈধ বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে কয়েকটি দেশে বেশিরভাগই টাকাই পাচার করতে সক্ষম হয়েছেন।

চাঞ্চল্যকর এসব তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট ওই সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরও তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।

আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘অপরাধ কখনও থামে না এবং এই করোনা মহামারির সময়েও তা থেমে থাকেনি।’

করোনা মহামারির কারণে টানা দুই মাস সাধারণ ছুটিতে সবকিছু বন্ধ থাকলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় বরং বেড়েছে। আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রতি মাসেই গড়ে ৩০৬টি সন্দেহজনক লেনদেনের খবর পেয়েছে— যেখানে গত বছর এই সংখ্যা ছিল ২৯৮। সন্দেহজনক লেনদেন সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। অন্যদিকে সরকারঘোষিত দীর্ঘ সাধারণ ছুটির কারণে সন্দেহজনক লেনদেন সবচেয়ে কম হয়েছে ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে।

আর্থিক গোয়েন্দারা ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক থেকে মোট ২ হাজার ৯০৮টি সন্দেহজনক লেনদেনের খবর পেয়েছে। অন্যদিকে বিকাশের মতো মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রোভাইডারগুলো থেকে একই সময়ে ৭০৩টি সন্দেহজনক লেনদেনের সংবাদ মিলেছে।

আর্থিক গোয়েন্দাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিজিটাল আর্থিক সেবা হাতের কাছে থাকার পরও বাংলাদেশের মানুষ এখনও নগদে লেনদেন করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন। অনেকেই নগদ লেনদেন বেছে নিচ্ছেন মূলত অবৈধ অর্থের উৎস এবং গন্তব্য লুকানোর জন্য। এছাড়া সন্ত্রাসী অর্থায়ন এবং অন্যান্য অপরাধের কাজেও নগদ লেনদেন অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!