হঠাৎ ভিডিওবার্তায় তারেক নিজেই ‘বিধ্বস্ত’, পরস্পরবিরোধী তথ্যে বড় গোলমাল

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

১৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের মর্মান্তিক সেই গ্রেনেড হামলা নিয়ে ভিডিওবার্তা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই মামলায় তিনি যাবজ্জীবন শাস্তিপ্রাপ্ত। অর্থপাচার এবং দুর্নীতির মামলায় এরই মধ্যে তার আরও সাজা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২ আগস্ট দুর্নীতি মামলায় তারেককে ৯ বছর ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

সোমবার (২১ আগস্ট) লন্ডন থেকে দেওয়া সেই ভিডিওবার্তায় নিজেকে তিনি ‘নির্দোষ’ প্রমাণের চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে যারা ওয়াকিবহাল, তারা বলছেন, তারেকের বক্তব্যের পুরোটাই মূলত মিথ্যাচার।

ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড

১৯ বছর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ঘটে এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হয়। ওই নৃশংস ঘটনায় মৃত্যুর হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই হামলায় নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী মিসেস আইভি রহমান অন্যতম, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী।

২০০৪ সালের সারাদেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২১ আগস্ট বিকেলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে বিকেল পাঁচটায় পৌঁছালে, একটি ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে তিনি কুড়ি মিনিটের বক্তৃতা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসতে থাকেন। ঠিক এমন সময় শুরু হয় মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১২ জন নিহত হন।

এ ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান, চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৫২ জনকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে অন্য মামলায় মুফতি হান্নানসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় তিনজন ছাড়াই বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

কী আছে তারেকের ভিডিওবার্তায়?

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় ২৬ মিনিটের ওই ভিডিওতে তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে একের পর এক মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করে গেছেন। মিথ্যা দিয়ে সত্যকে যেমন ঢাকা যায় না, তারেক রহমানও তার ভিডিও বার্তায় সত্যকে লুকাতে পারেননি।

জজ মিয়া নাটক কার বানানো?

ভিডিওবার্তার আলোচনায় প্রথমেই জজ মিয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তারেক রহমান। বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক খুবই হাস্যকরভাবে জজ মিয়াকে সামনে আনার দায়ভার চাপিয়েছেন আওয়ামী লীগের ওপর। কিন্তু তিনি একবারও বললেন না, এই জজ মিয়া নাটক মূলত বিএনপিরই সৃষ্টি। যা উদঘাটিত হওয়ার পর দেশে-বিদেশে তুমুল বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল।

বরং প্রকৃত ঘটনা হলো, ওই জজ মিয়াই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল মাস্টারমাইন্ডদের ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। গ্রেনেড হামলাকে ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিএনপি-জামাত জোট সরকারই নিরপরাধ জজ মিয়াকে দিয়ে নাটক সাজিয়েছিল। জজ মিয়াই গ্রেনেড হামলা করেছিল— এই জবানবন্দি তার কাছ থেকে পুলিশ জোরপূর্বক আদায় করেছিল। পরে সেসব কথা জজ মিয়া আদালতে স্বীকার করেছেন।

মুফতি হান্নান দোষী, কিন্তু তার জবানবন্দি?

তারেক রহমানের ভিডিওবার্তায় সন্ত্রাসী ও হরকাতুল-উল-জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশ শাখার প্রধান মুফতি হান্নানের প্রসঙ্গও এসেছে। একাধিক অপরাধের জন্য তিনি মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত হন এবং ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

মুফতি হান্নানের ব্যাপারে ভিডিওবার্তায় তারেক রহমান বলেন, তার বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া। এটিও ভুল তথ্য। প্রকৃতপক্ষে হান্নানের বাড়ি কোটালিপাড়ায়।

তবে তারেক রহমান তার বক্তৃতায় স্বীকার করেছেন, মুফতি হান্নানই দোষী। অর্থাৎ আদালত মুফতি হান্নানের বিষয়ে যে রায় দিয়েছেন, তা মেনে নিয়েছেন তারেক রহমান। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি সেটাই হয়, তাহলে তারেক রহমান সম্পর্কে আদালতের রায়ও অসত্য হতে পারে না। তারা বলছেন, প্রকারান্তরে তারেক রহমান নিজের দোষই স্বীকার করে নিয়েছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মুফতি হান্নানকে দোষী হিসেবে স্বীকার করে নিলেও হান্নানের সঙ্গে হাওয়া ভবনে তার যোগাযোগের কথা বেমালুম চেপে গেছেন তারেক রহমান। এমনকি হামলার আগে বিএনপির তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর সঙ্গে হান্নানের সখ্যের বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছেন সুকৌশলে।

২০০৭ সালের ১ নভেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে মুফতি হান্নান বিবরণ দেন—‘…পরদিন মাওলানা তাহের আহসান উল্লাহ ও আবু জান্দালকে মিরপুর ১ নম্বর পানির ট্যাংকের কাছে মসজিদে আকবর কমপ্লেক্সে যেতে বলেন। সেখানে আবদুস সালাম পিন্টু তাঁর সার্বিক কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত ও করণীয় কাজের ধরন বর্ণনার পর আবু জান্দাল ও কাজলকে নির্দেশনা দেন এবং জনসভাস্থলে যাঁরা হামলার দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের নামের তালিকা দেন। এরপর ২০-০৮-০৪ তারিখে তাঁদের পিন্টু সাহেবের বাসায় যেতে বলেন। সে অনুযায়ী ২০ তারিখ বেলা ১১টার দিকে জান্দাল ও কাজল পিন্টু সাহেবের বাসায় যান। তখন আবদুস সালাম পিন্টু ও তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন মাওলানা তাহেরের উপস্থিতিতে হামলার জন্য ১৫টি গ্রেনেড জান্দাল ও কাজলকে দেন এবং আবু তাহের খরচ বাবদ জান্দাল ও কাজলকে দুই হাজার টাকা দেন। তখন আবু তাহের বলেন, তিনি ২১-০৮-০৪ তারিখ সকালে বাড্ডার বাসার অফিসে আসবেন। বাকি সিদ্ধান্ত তখন সেখানে অর্থাৎ বাড্ডায় গ্রহণ করা হবে। আমি আহসান উল্লাহ কাজলের কাছ থেকে জানি, আবদুস সালাম পিন্টু শেখ হাসিনার ২১ তারিখের জনসভায় হামলার জন্য ছয়জন লোক দেবেন। তখন পিন্টু কাজলকে ওই ছয়জনের একজনের সঙ্গে পরিচয় করান। এরপর আহসান উল্লাহ কাজল ও মাওলানা আবু তাহেরের তালিকা অনুযায়ী সবাইকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংবাদ দেওয়া হয়।‘

কেন লাগলো ১৪ মাস সময়?

ভিডিওবার্তায় তারেক রহমান জানান, ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর তার সরকারের আমলেই মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৪ মাস পর কেন হান্নানকে গ্রেপ্তার করা হলো? এতো দেরি হওয়ার কারণ কী? হামলার আরেক মাস্টারমাইন্ড মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তাজউদ্দীনকে বিদেশ পাঠানোর সুযোগ কে করে দিল— সেই প্রশ্নের জবাবও এড়িয়ে গেছেন তারেক রহমান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমান অনেককিছু এড়িয়ে গেলেও মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর আছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর মুফতি হান্নানকে সকল সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন তারেক রহমান। কিন্তু মাঝখানে ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজিয়ে প্রকৃত আসামিদের বাঁচিয়ে দিতে দিতে সময়ক্ষেপণ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলন আর দেশি-বিদেশি চাপে বাধ্য হয়ে মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

আওয়ামী লীগের সভাস্থল নিয়ে ধোঁয়াশার চেষ্টা

তারেক রহমান তার ভিডিওবার্তায় বলেছেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ তড়িঘড়ি করে সমাবেশস্থল মুক্তাঙ্গন থেকে সরিয়ে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে নিয়ে যায়।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সমাবেশের দুই দিন আগে ১৯ আগস্ট থেকেই প্রচারণা করে আসছিল সমাবেশের স্থান ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। মুক্তাঙ্গনে সমাবেশের অনুমতিই দেওয়া হয়নি আওয়ামী লীগকে। এমনকি ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কোনো মঞ্চও প্রস্তুত করতে দেওয়া হয়নি। ওই সময় প্রায় সব গণমাধ্যমে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশের বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হয়েছিল।

পরস্পরবিরোধী অবস্থান

ভিডিওবার্তায় তারেক রহমান বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় পরিকল্পিতভাবে তার নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, মুফতি হান্নানকে যদি তারেক অপরাধী হিসেবে স্বীকার করে নেন, তাহলে মুফতি হান্নানের জবানবন্দিকে তার অস্বীকার করার সুযোগ নেই। জবানবন্দিতে মুফতি হান্নান স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন, তারেক রহমানের সঙ্গে হাওয়া ভবনে তার একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। এমন অনেক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই পাওয়া যায়।

জানতেন অনেকেই

বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমান অনেক আগে থেকেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা জানতেন। তার একান্ত আজ্ঞাবহ তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু সরাসরি মর্মান্তিক ওই হামলায় পৃষ্ঠপোষকতা দেন। এছাড়া ডিজিএফআই, এনএসআই ছাড়াও পুলিশের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও এমন ঘটনা যে ঘটবে— তা আগে থেকেই জানতেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!