সাতকানিয়ায় সাইফুল বাহিনীর তাণ্ডব, ভাঙা বন্দুক গুঁজে ফাঁসানো হল মুমূর্ষু গাড়িচালককে

তিনজন গুলিবিদ্ধ ছাড়াও আহত ২০

ঈদের সময়েই চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় পুরো একটি পাড়ায় তাণ্ডব চালিয়েছে হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা। এক গাড়িচালককে নির্মমভাবে পেটানোর পর মুমূর্ষু অবস্থায় হাতে ভাঙা বন্দুক ধরিয়ে পুলিশে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। ওই ব্যক্তি এখন পুলিশ হেফাজতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মারধর করে অস্ত্র গুঁজে দিয়ে ফাঁসানোর সাম্প্রতিকতম ঘটনা এটি। সাতকানিয়া থানা পুলিশের সহযোগিতায় এর আগে এ ধরনের অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। একই দিন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়ি ছাড়াও বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর করে সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের হামলায় স্থানীয় অন্তত তিনজন গুলিবিদ্ধ ছাড়াও ২০ জন আহত হয়েছেন। সব জেনেও পুলিশ সন্ত্রাসীচক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেয়নি।

মঙ্গলবার (১৮ জুন) ঈদের দ্বিতীয় দিনে এমন নারকীয় ঘটনা ঘটেছে সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ইউনিয়নে। অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে রীতিমতো বাহিনীর আদলে এলাকায় অবস্থান নিয়ে এই তাণ্ডব চালায়। স্থানীয়দের কাছে এই সন্ত্রাসীরা ‘সাইফুল বাহিনী’ নামে পরিচিত।

প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়াও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মঙ্গলবার (১৮ জুন) দুপুরে চরতী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড গাইনার বাড়ি এলাকায় স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়িতে আবু ছালেক নামের এক ব্যক্তি বেড়াতে আসেন। এ সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নিয়ে গাড়িচালকের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। এর একপর্যায়ে গাড়িচালক জিহানের সঙ্গে হাতাহাতি হয়। জিহান বিষয়টি চরতী ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সাইফুলকে জানান। সঙ্গে সঙ্গে সাইফুল অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত তার ‘বাহিনী’ নিয়ে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গাইনা বাড়িতে এসে অবস্থান নেন।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সাইফুলের বাহিনী শুরুতে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নুর মোহাম্মদের বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। এরপর তারা আরও বেশ কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর করে। এ সময় সাইফুল বাহিনীর সন্ত্রাসীরা স্থানীয়দের মারধর করে। বিভিন্ন বাড়ির নারীদেরও পেটানো হয় এ সময়। নারীদের তারা অশ্লীল গালিগালাজও করে।

পরবর্তীতে স্থানীয় এলাকাবাসী সম্মিলিতভাবে সাইফুল বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সাইফুল বাহিনীর হামলায় স্থানীয় অন্তত ২০ জন আহত হন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন অন্তত তিনজন। এরা হলেন— রুবেল, শাহজাহান কবির ও প্রবাসী জাহাঙ্গীর। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার একপর্যায়ে মোহাম্মদ আতিক নামে একজনকে আটকে সাইফুল বাহিনী নির্মমভাবে মারধর করে। এরপর মুমূর্ষু অবস্থায় প্রায় অচেতন অবস্থায় আতিকের পাশে একটি ভাঙা পরিত্যক্ত বন্দুক ফেলে রেখে তাকে অপেক্ষমাণ পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়।

হেলমেট পরে এসেছিল ২০ ভাড়াটে অস্ত্রধারী

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এদিনের ঘটনায় আমিলাইশ ইউনিয়ন, কাঞ্চনা ইউনিয়ন ও ডলুকুলের অন্তত ২০ জন ভাড়াটে সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ চরতীতে নিয়ে আসে সাইফুলের বাহিনী। অন্যদিকে সাইফুল বাহিনীর সদস্য আবুল হাশেমের ছেলে নাছির, হাশিমের ছেলে ছোটন, আবদুল মতলবের ছেলে কোরবান আলী, সুলতান আহমেদের ছেলে কামরুল ইসলাম ও বদরুল ইসলাম, পুতুন আলীর ছেলে আরাফাত, হাচি মিয়ার ছেলে আরিচ, জামালের নেতৃত্বে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তাণ্ডবে অংশ নেন। সন্ত্রাসীদের সবাই হেলমেট পরে রীতিমতো পুলিশের সাজে হামলায় অংশ নেয়।

অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর পুরনো কৌশল

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মারধর করে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো সাইফুলের পুরনো কৌশল। এর আগে পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে মিজবাহ নামের দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করেছিল সাইফুল। এছাড়া আশরাফ নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে একই কায়দায় পুলিশে সোপর্দের অভিযোগ রয়েছে সাইফুলের বিরুদ্ধে।

ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘মারধর করে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো সাইফুলের পুরনো অভ্যাস। স্থানীয়রা সাইফুল বাহিনীর কাছে অসহায়। মুখ খুলতে ভয় পায়। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তার শাস্তি চাই।’

এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাইফুল বাহিনীর প্রধান ও চরতী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সাইফুলের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

সন্ত্রাসীদের সাফাই গাইছে পুলিশ

সাতকানিয়া থানার পুলিশ সাইফুল ও তার বাহিনীকে সবরকম সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে— এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। এই বাহিনীর নেতৃত্বে গত ছয় মাসে সাতকানিয়ার চরতি-আমিলাইশ এলাকায় অন্তত ৩০টি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও একজন সন্ত্রাসীকেও ধরেনি পুলিশ। সর্বশেষ মঙ্গলবারের (১৮ জুন) ঘটনায়ও পুলিশ সরাসরি সাইফুলের পক্ষ নিয়েছে বলে অভিযোগ এনেছেন এলাকাবাসী।

ওই ঘটনায় আহত এক ব্যক্তি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুপুরে সাইফুলের বাহিনী যখন এলাকায় তাণ্ডব চালাচ্ছিল, তখন এলাকার অনেকেই ট্রিপল নাইনে ফোন করে পুলিশের সহায়তা চায়। কিন্তু পুলিশের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। ঘটনার দুই ঘন্টা পর প্রচণ্ড মারধরে আহত আতিকের পাশে সাইফুলের লোকজন এসে ভাঙা একটি বন্দুক রেখে যাওয়ার পর তারাই সাতকানিয়া থানায় ফোন করে। এর পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আতিককে টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে যায়।’

মঙ্গলবারের (১৮ জুন) তাণ্ডবের ঘটনায় থানায় একটি মামলা হলেও সেটির বাদি করা হয়েছে সাইফুল বাহিনীর সদস্য ট্যাক্সিচালক জিহানকে।

এলাকার বাসিন্দা নাদিম মাহমুদ বলেন, ‘অটোরিকশাচালক জিহান মূলত সাইফুলের লোক। জিহানকে সঙ্গে নিয়েই ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গাইনা বাড়িতে হামলা চালায় সাইফুল। এতে ২০ জন আহত হয়। তাদের মধ্যে আতিক নামে একজনকে আটকে সাইফুল বাহিনী মারধর করে। পরবর্তীতে মুমূর্ষু অবস্থায় একটি ভাঙা পরিত্যক্ত অস্ত্র দিয়ে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে।’

তবে সাইফুলের পক্ষে সাফাই গেয়ে সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রিটন সরকার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মেম্বার সাইফুল এই ঘটনার অনেক পরে গেছে, ঘটনার দুই ঘন্টা পর সাইফুল ঘটনাস্থলে গেছে।’

ওসি দাবি করেছেন, ‘গুলি ও দা দিয়ে কোপানোর পর যখন অভিযুক্ত আতিক পালাচ্ছিলো তখন স্থানীয় জনগণ ধরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে।’

এর আগেও সাইফুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে লোক ফাঁসানোর অভিযোগ রয়েছে— এমন প্রশ্নের উত্তরে ওসি প্রিটন সরকার ‘কিছুই জানেন না’ বলে জানান।

ভোটের পর সাইফুল আরও বেপরোয়া

চরতীর বিভিন্ন পর্যায়ের লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তঃজেলা ডাকাত সর্দার মৃত নুর আহমেদের ছেলে সাইফুল একসময় প্রবাসী ছিলেন। ২০১৭ সালের দিকে দেশে ফিরে এলাকায় গঠন করেন কিশোর গ্যাং। চরতীর বুক চিরে বয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন শুরু করেন তিনি। একই সঙ্গে ইয়াবার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন সাইফুল। ইয়াবা ও বালু বিক্রির টাকায় বাহিনীর জন্য কেনেন অত্যাধুনিক বিভিন্ন অস্ত্র। শুধুমাত্র গত সংসদ নির্বাচনের আগেই অন্তত ২০টি অস্ত্র কিনেছেন সাইফুল— এলাকায় এমন জনশ্রুতি রয়েছে।

একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির থেকে চাঁদা আদায় করতে থাকে সাইফুলের বাহিনী। সাতকানিয়ার রাজনীতিতে যখন যিনি প্রভাবশালী ছিলেন, তার ছায়ায় আশ্রয় নেন সাইফুল। ২০২২ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবু রেজা নদভীর সহায়তায় ইউপি মেম্বার নির্বাচিত হন তিনি। গত সংসদ নির্বাচনের কিছু সময় আগে নদভীকে ছেড়ে উপজেলা চেয়ারম্যান এমএ মোতালেবের কাছে আশ্রয় নেন তিনি।

চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে এমএ মোতালেব সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সাইফুল ও তার বাহিনী। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে সাতকানিয়ার চরতি-আমিলাইশ এলাকায় অন্তত ৩০টি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে এই বাহিনী। থানা পুলিশ জানিয়েছে, এসব ঘটনায় কমপক্ষে ২০টি অভিযোগ জমা পড়েছে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে। তবে বাকিরা ভয়ে মুখ খোলেনি।

মেম্বারের মার খাচ্ছে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগই

জানা গেছে, ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই দক্ষিণ চরতিতে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের বাড়ি-ঘর-দোকানে হামলা ও লুটপাট চালায় সাইফুল বাহিনী। এই সময় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য ইলিয়াছ শাহীনের ফার্মেসি এবং কৃষক লীগ নেতা ফারুকের বাড়ি ও ডেকোরেশনের দোকানে লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। চরতী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ঢুকে বর্তমান চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরীকে মারধর করে সাইফুল বাহিনী। দক্ষিণ চরতী এলাকার ডিশ ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে পরিবারসহ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে সাইফুল বাহিনী। নির্বাচনের পর থেকে এখনও ঘরছাড়া নুর মোহাম্মদের পরিবার। চরতী ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি মাইনুদ্দিনকে মারধর করে অপহরণ ছাড়াও দক্ষিণ চরতির আরাফাত সিকদারকে নির্মমভাবে মারধর করে এই সাইফুল বাহিনী।

জাতীয় নির্বাচনের আগে ২১ ডিসেম্বর রাতে দক্ষিণ চরতি কাটাখালী ব্রিজের পাশে নৌকাপ্রার্থী আবু রেজা নদভীর স্ত্রী ও মহিলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য রিজিয়া রেজা চৌধুরীর পথসভায় অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায় সাইফুল ও তার বাহিনী। এ ঘটনায় এমপির শ্যালক ও চরতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরীসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন। সাইফুলের নেতৃত্বে পরিচালিত হামলায় এ সময় আরও আহত হন উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মন্নান (৩০), পৌর আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম ফেরদৌস রুবেল (৫৫) প্রমুখ।

এর দুই দিন আগে ১৯ ডিসেম্বরও নৌকাপ্রার্থী পথসভা শেষে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য ইলিয়াছ শাহীনকে মারধর করে সাইফুল বাহিনী।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে সন্ত্রাসী সাইফুল বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে যায় দক্ষিণ চরতির ১০ পরিবার। নারী ও শিশুসহ এসব পরিবারের অর্ধশতাধিক লোক দীর্ঘ এক বছর নিজেদের ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর উদ্বাস্তুর মতো দিনযাপন করছেন। বাড়ি-ভিটে ফিরে পেতে ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেন উদ্বাস্তু পরিবারসহ এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!