শ্রমিক সুরক্ষায় রেলের দুই কর্মকর্তার লুকোচুরি, বাড়ছে অসন্তোষ

৩১ মার্চ, সকাল সাড়ে সাতটা। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলস্টেশন থেকে গ্যাংকার ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত তিনটি মালবাহী বগির উপর উঠানো হল শত শত শ্রমিক। গন্তব্য তাদের চিনকি আস্তানা রেললাইন পর্যন্ত। তাদের কারও মুখে নেই কোন মাস্ক কিংবা সুরক্ষা সরঞ্জাম। এমন গাদাগাদি করে তাদের তোলা হয়েছে, তিলধারণেরও ঠাঁই নেই ওই বগিগুলোতে। এতে পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি ছিল নারী শ্রমিকও। এসব শ্রমিককে ভাগ করে নামানো হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত চলমান রেললাইন সংস্কার কাজে।

শ্রমিকদের অবস্থা সরেজমিন দেখতে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের প্রতিবেদকও তাদের সঙ্গী হন। কাজ শেষে বিকেলে এই বগিগুলো শ্রমিকদের নিয়েই ফিরে আসার কথা চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। কিন্তু সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া কর্মরত শ্রমিকদের ছবি তুলতে গেলে দেখে ফেলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই কর্মকর্তা। মুহূর্তেই মালবাহী বগিযুক্ত গ্যাংকার ইঞ্জিন চালু করে শ্রমিকদের না নিয়েই দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন তারা।

এটি শুধু এ দিনের চিত্র নয়। দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পরও প্রতিদিন এভাবেই রেলওয়ের শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে রেললাইন সংস্কারের কাজে। অথচ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সতর্কতার অংশ হিসেবে প্রত্যেককে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। মাস্কসহ সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিতের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে চট্টগ্রাম রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় দফতরের অধীনে কাজ করা শ্রমিকদের কাজে যোগদানে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। উল্টো তাদের গাদাগাদি করে মালবাহী বগিতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কর্মস্থলে। বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে শ্রমিকদের মাঝে।

শ্রমিক সুরক্ষায় রেলের দুই কর্মকর্তার লুকোচুরি, বাড়ছে অসন্তোষ 1

শ্রমিকদের অভিযোগ, সরকার যেখানে ন্যূনতম তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে বলেছে, মাস্ক ও অনান্য নিরাপত্তা সরঞ্জামও নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছে, সেখানে গাদাগাদি করে, সুরক্ষা প্রদান ছাড়াই রেলওয়ের দুই কর্মকর্তা গত এক সপ্তাহ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়েছেন। কাজে নামাতে শ্রমিকদের ভয়ভীতিও দেখিয়েছেন পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর (পিডাব্লিউআই) এরফানুর রহমান ও অ্যাসিসট্যান্ট পার্মানেন্ট ইন্সপেক্টর মো. সোলায়মান— এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।

শ্রমিকরা জানান, চট্টগ্রাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত রেললাইন সংস্কারের কাজ তদারকির দায়িত্বে ছিলেন এ দুই কর্মকর্তা। তারা শ্রমিকদের কাজে আসতে বলেন সময়মত। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে শ্রমিকরা গাদাগাদি করে মালবাহী বগিতে উঠতে চাননি। এসময় শ্রমিকরা মাস্ক প্রয়োজন বলেও এ দুই কর্মকর্তাকে জানান। কিন্তু তারা শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে সুরক্ষা প্রদান ছাড়া্ই কাজে নিয়ে যান। উল্টো ৩১ মার্চ প্রায় অর্ধেক শ্রমিক না নিয়েই গ্যাংকার চালিয়েই চিনকি স্টেশন থেকে চলে আসেন।

শ্রমিক সুরক্ষায় রেলের দুই কর্মকর্তার লুকোচুরি, বাড়ছে অসন্তোষ 2

শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, পরদিন ১ এপ্রিল ১০ মিনিটের জন্য শ্রমিকদের হাতে গ্লাভস ও মাস্ক দিয়ে মোবাইলে ছবি তুলে ও ভিডিও করে দুই জন রেলওয়ে কর্মকর্তা। এরপর এসব আবার ফেরত নিয়ে নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে অ্যাসিসট্যান্ট পার্মানেন্ট ইন্সপেক্টর মো. সোলায়মান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমাকে কাজগুলো করতে হয়। এখানে আমি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি।’

তবে ৩১ মার্চের (মঙ্গলবার) এ ঘটনা জানাজানি হলে টনক নড়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতরের। ১ এপ্রিল থেকেই পাল্টে যায় দৃশ্য। গাদাগাদি করে নেওয়ার পরিবর্তে ওইদিন থেকে ৪ জন করে শ্রমিককে কর্মস্থলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতর। এ সময় শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষা সরঞ্জান প্রদানেরও সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।

পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর এরফানুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘৩১ মার্চের ঘটনা শোনার পর পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক গাদাগাদি করে শ্রমিকদের কর্মস্থলে যাতায়াত বন্ধের নির্দেশ দেন। এখন থেকে কিছু ট্রেন চলাচল শুরু করবে। এতে গ্যাংকারে করে অতিরিক্ত শ্রমিক পরিবহনের প্রয়োজন হবে না।’

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় বিভাগীয় প্রকৌশলী (১) হামিদুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যক্তি উদ্যোগে আমি শ্রমিকদের জন্য গ্লাভস ও মাস্ক ব্যবস্থা করেছি। যদি শ্রমিকদের হাতে এসব দিয়ে ছবি তোলার পর আবার ফেরত নেওয়ার ঘটনা ঘটে তাহলে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) নাসির উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রেললাইন সচল রাখতে হবে। এটার কোন বিকল্প নেই। শ্রমিকদের বিষয়টি আমরা অবহিত হওয়ার পর ১ এপ্রিল থেকে শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করেছি।’

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!