বোবা শিশুটির ঘরে কে ছড়াল করোনার বিষ?

বয়স তার মোটে ৬। এই বয়সী শিশুরা বাড়ির উঠোন দাপিয়ে বেড়ালেও জন্ম থেকেই শিশুটি উঠোন দেখেছে বাড়ির ভেতর শুয়ে শুয়ে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েই পৃথিবীর আলো দেখেছিল শিশুটি। বয়স একটু বাড়ার দেখা গেল, কথাও বলতে পারে না সে— বাকপ্রতিবন্ধীও। বয়স যখন ছয়, তখন কঠিন পৃথিবীতে আরেক অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি পড়ে গেল শিশুটি।

রোববার (১২ এপ্রিল) রাতে শিশুটি নিরবেই নিজেকে খুঁজে নিল অ্যাম্বুলেন্সের স্ট্রেচারে, জীবনের ঝুঁকি জেনেও পাশে ঠিকই মমতাময়ী মা উদাস চোখে! চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল থেকে পাঠানো বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সটি যখন শিশুটিকে নিয়ে চট্টগ্রামের পটিয়ার হাইদগাঁও থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, দূর থেকে প্রতিবেশীদের ফিসফাস একসময় হয়ে দাঁড়াল বহুমূল্যের প্রশ্ন— বোবা শিশুটিকে কে ছুঁয়ে দিল করোনার বিষ? শারীরিক অক্ষমতায় যেখানে শিশুটির বাইরে যাওয়ার সুযোগই নেই, ৬ বছরের সেই শিশু করোনা পেল কোথা থেকে?

এখন পর্যন্ত এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে, অজ্ঞাত কোনো এক করোনা রোগী কোনো না কোনোভাবে ওই শিশুটির স্পর্শে এসেছে। করোনার বীজ বহন করা সেই রোগী ওই শিশুটির ঘরেও ঢুকেছেন। কিন্তু কে সেই করোনা রোগী— এই প্রশ্নই এখন ভাবিয়ে তুলেছে পটিয়ার প্রশাসনকে। বাবা যেহেতু ঘরের বাইরে যান, তিনি কার কার সংস্পর্শে গেছেন সেটাও ভাবাচ্ছে প্রশাসনকে।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, পটিয়ার হাইদগাঁও ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে ওই শিশুর পরিবার যে বাড়িতে থাকে, তার পাশেই একজন ওমানফেরত ব্যক্তি এবং একজন ব্যাংক কর্মকর্তার বাড়ি। এর মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তার বাড়ি ওই শিশুর বাড়ির একেবারে লাগোয়া। তিনি ইসলামী ব্যাংকের ঢাকা নবাবপুর শাখার কর্মকর্তা। ৫-৬ দিন আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পটিয়ায় নিজ বাড়িতে এসেছেন তিনি। অন্যদিকে ওমানফেরত প্রবাসী ব্যক্তিটি পটিয়ার বাড়িতে এসেছেন মার্চের শেষ দিকে।

পটিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা জাহান উপমা জানান, বিদেশফেরত ও ঢাকা থেকে ফেরা ব্যাংকার— এই তথ্য জেনে দুই দফায় গিয়ে দুজনকেই হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারা ওই নির্দেশ না মেনে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছিলেন। খবর পেয়ে সর্বশেষ গত মঙ্গলবারও (৮ এপ্রিল) ইউএনও ওই এলাকায় যান। সেখানে গিয়ে তাদের জরিমানা করতে চাইলে দুজনই কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা মানবেন বলে অঙ্গীকার করেন। এরপর আর জরিমানা করা হয়নি।

কিন্তু দেখা গেছে, গত বৃহস্পতিবার (৯ এপ্রিল) থেকেই ছেলেটার সর্দি-কাশি শুরু হয়, সঙ্গে জ্বরও। অবস্থার অবনতি ঘটলে শনিবার (১১ এপ্রিল) শিশুটিকে পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।

পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. মো. জাবেদ জানান, শনিবার (১১ এপ্রিল) সকালে শ্বাসকষ্ট নিয়ে প্রতিবন্ধী শিশুটি পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা করাতে আসে। এ সময় বর্হিবিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশুটির সিম্পটম (উপসর্গ) দেখে ফ্লু কর্নারে নিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। পরে ওই নমুনাটি চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের বিশেষায়িত হাসপাতাল বিআইটিআইডিতে পাঠানো হয়। এরপর রোববার (১২ এপ্রিল) রাতে নমুনা পরীক্ষায় শিশুটি করোনা পজেটিভ আসে।

শিশুটির পারিবারিক অবস্থা জানতে গিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিন জানতে পেরেছে, শিশুটির বাবা আগে ওমানপ্রবাসী ছিলেন। মাসচারেক আগে দেশে ফিরে তিনি আর ওমানে যাননি। তখনও অবশ্য করোনার মহামারি শুরু হয়নি। দেশেই এখন ছোটখাটো ব্যবসা করছেন তিনি। পটিয়া উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট জানান, যদিও অনেক আগে শিশুটির বাবা দেশে ফিরেছেন। তবু বিদেশফেরত জেনে তাকে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

শিশুটির পরিবারসূত্রে জানা যায়, শিশুটির এক চাচা হংকং থেকে একমাস আগে পটিয়ার বাড়িতে এসেছিলেন। তবে তিনি এক সপ্তাহ বাড়িতে থাকার পর আবার হংকং চলে যান।

শিশুটির করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় ইতিমধ্যে পটিয়ার হাইদগাঁও এলাকায় ৫০টিরও বেশি বাড়ি লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যখন শিশুটি গিয়েছিল, কারা ওই সময় শিশুটির সংস্পর্শে এসেছেন— এটিও এখন ভাবাচ্ছে প্রশাসনকে। শিশুটির পিতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে ফোনে জানিয়েছেন, অন্যদের মতো তিনিও হাটবাজারে যান। মাঝে মাঝে চায়ের দোকানেও আড্ডা দেন।

তবে পটিয়া উপজেলা প্রশাসন প্রতিবন্ধী শিশুটির বাবা কোথায় যেতেন, কাদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন— সে বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছে। নিশ্চিত হলে লকডাউনের পরিসর আরও বড় হতে পারে বলে জানিয়েছেন ইউএনও ফারজানা জাহান উপমা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!