ডাক্তার সংকট—আয়াদের দুর্ব্যবহার চরম অব্যবস্থাপনায় চমেক ডেন্টাল

৬ মার্চ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নানা আয়োজনে যখন পালিত হচ্ছিল ‘ওয়ার্ল্ড ডেন্টিস্ট ডে’ তখন হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগে রোগিরা চিকিৎসা নিচ্ছিলেন নানা অব্যবস্থাপনায়। দিবস পালনে যত আয়োজন, চিকিৎসায় নেই তার ছোঁয়া। ডাক্তার স্বল্পতা, ওটিতে সরঞ্জামাদির অভাব, এক্সরে মেশিন নষ্ট, আয়াদের দুর্ব্যবহার সব মিলিয়ে চমেক হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগ রোগিদের কাছে এক বিড়ম্বনারই নাম।

শুধু চমেক হাসপাতাল নয়, উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতেও চলছে চরম অব্যবস্থাপনা। ডেন্টাল সার্জন না থাকায় গ্রামের রোগিরা হাতুড়ে দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়ে অপচিকিৎসার শিকার হয়ে ক্যান্সার বাঁধিয়ে ফেলছেন দাঁতে।

বছর বছর তাই ওয়ার্ল্ড ডেন্টিস্ট ডে’র কর্মসূচি র‌্যালি আর আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ।

জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগে ফিল্ম ও কেমিক্যাল না থাকার কারণে ডেন্টাল বিভাগের এক্স-রে মেশিনটি অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে ডেন্টাল বিভাগের রোগিরা বঞ্চিত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা থেকে। এতে রোগিদের অতিরিক্ত টাকা খরচ করে বেসরকারি ল্যাবে গিয়ে এক্স-রে করাতে হচ্ছে। ডেন্টাল বিভাগে পোর্টেবল ডেন্টাল এক্স-রে মেশিন ইমেজিং স্কেপ আছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এ মেশিনে বহির্বিভাগের রোগিদের কোন এক্স-রে করা হয় না। বলা হয়ে থাকে মেশিন নষ্ট। অভিযোগ রয়েছে, এসব ল্যাব থেকে কমিশন পায় ডেন্টাল বিভাগের ডাক্তাররা।

প্রথমে ডেন্টাল বিভাগে কোন রোগি চিকিৎসা নিতে আসলে বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখিয়ে দাঁতের এক্সরে করার জন্য তাদের পছন্দের ল্যাবের স্লিপ ধরিয়ে দেন। হাসপাতালের এক্স-রে মেশিনটি চালু থাকলে ৫০ টাকা দিয়ে এক্স-রে করানো যেত। এখন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করাতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা গুণতে হয় রোগিদের। অধিকাংশ সময় প্রবর্তকের মোড়ে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই এক্সরে করতে পাঠানো হয় রোগিদের।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ডেন্টাল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার আকরাম পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের এক্স-রে মেশিন আছে। কিন্তু কোন ধরণের এক্স-রে হয় না। এক্স-রে করার ফিল্ম ও কেমিক্যালের অভাবে। হাসপাতাল থেকে কোন ধরণের এক্স-রে ফিল্ম আমাদের দেওয়া হচ্ছে না। তাই এক্স-রে মেশিনটি অকেজো পড়ে আছে। বাধ্য হয়ে রোগিদের আমরা বাইরের ল্যাবে পাঠাতে বাধ্য হয়েছি।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগের উপ-পরিচালক আখতারুল ইসলাম ডেন্টাল বিভাগের জন্য প্রায় ১২ লাখ টাকার নতুন হাই ফ্রিকোয়েন্সি মেডিকেল এক্স-রে ইমেজিং ক্রয়ের জন্য দরপত্র করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এর মধ্যেই তিনি বদলী হয়ে অন্যত্র চলে যান। বর্তমান টেন্ডার প্রক্রিয়া কি অবস্থায় আছে তা আমার জানা নেই।’

এছাড়াও ডেন্টাল বিভাগে রয়েছে চিকিৎসক স্বল্পতা। চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে অর্ধেক জনবল দিয়ে। ওটিতে রয়েছে যন্ত্রপাতির স্বল্পতা। অধিকাংশ যন্ত্রপাতি পুরোনো। চিকিৎসার সিরিয়াল পেতে রোগিদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বারান্দায় অপেক্ষা করতে হয়। আয়াদের দিয়ে কাজ চলে ওটিতে। রোগিদের কাছ থেকে বখশিসের নামে বাড়তি টাকা নিয়ে সিরিয়াল আগে করে দেয়া হয় রোগিদের। এ অবস্থা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগের।

কিন্তু গ্রামের অবস্থা করুণ। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন করে ডেন্টাল সার্জনের পদ থাকলেও সেসব পদ শূন্য রয়েছে বছরের পর বছর। কারণ ওই পদে নিযুক্ত ডেন্টাল সার্জনরা ডেপুটেশনের নামে চলে আসেন শহরে। ফলে গ্রামের মানুষেরা সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে এলাকার হাতুড়ে দাঁতের ডাক্তারের কাছে শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছেন।

কৃত্রিম দাঁত প্রতিস্থাপন, স্কিলিং, ফিলিং, দাঁত ও মাড়ির রোগের চিকিৎসায় এসব হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন রোগিরা। আর এই ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত: অর্ধশত দাঁতের রোগি ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক আকতার পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘মফস্বলে দাঁতের চিকিৎসায় হাতুড়ে ডাক্তাররা সঠিক জ্ঞানের অভাবে বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নেন। হাতুড়ে ডাক্তাররা ফিলিং ও নকল দাঁত তৈরিতে সাধারণত ব্যবহার করেন সেল্ফ কিউর রেজিন নামে এক ধরনের উপাদান যা মূলত এক ধরনের প্লাস্টিক আইটেম। সুবিধা হচ্ছে, এই উপকরণটি দিয়ে তারা অল্প সময়ে নকল দাঁত তৈরি বা ফিলিং করে দিতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এটা দীর্ঘ সময় ধরে মুখে থাকার কারণে এ থেকে ক্যান্সার হওযার আশঙ্কা থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা দাঁতের গোড়া অবশ করতে ইথাইল ক্লোরাইড অথবা ফরমাল ডিহাইড নামক কেমিক্যাল ব্যবহার করেন, যা মুখের টিস্যুগুলোকে বার্ন করে দেয়। এর থেকে প্রথমে ঘা হয় এবং পরে সেখানে ক্যান্সার হয়।’

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের বহির্বিভাগে প্রতি সপ্তাহেই ৪৫ থেকে ৫০ জন রোগি আসেন যারা ভুল চিকিৎসার শিকার। অপচিকিৎসায় তারা ক্যান্সারের পর্যায়ে এসে ডেন্টাল ইউনিটে ভর্তি হন। এসব রোগিরা আসেন চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। যারা দাঁতের চিকিৎসায় শুরুতেই হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলার ১৪ উপজেলার মধ্যে ৭টিতে নেই কোনো ডেন্টাল সার্জন। মফস্বলে পোস্টিং পাওয়া ডেন্টাল সার্জনরা ডেপুটেশনে চমেকের ডেন্টাল ইউনিটে চলে আসেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট স্থাপন করা হলেও সেখানে কোনো পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ডেপুটেশনে আসা চিকিৎসক দিয়ে চলে এ ডেন্টাল ইউনিট। চমেক সূত্রে জানা গেছে, ডেপুটেশনে আসা চিকিৎসকরা বছরের পর বছর ধরে শহরে থাকার জন্যই এ ইউনিটে কোনো পদ সৃষ্টি করা হয় না।

কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!