ডাক্তারিতে তিন যুগের বর্ণাঢ্য অধ্যায় শামীম বকসের, জানালেন সাফল্যের রহস্য

ডা. শামীম বকস্। সবাই তাকে চেনেন ‘পেটের রোগের ডাক্তার’ হিসেবে। চট্টগ্রামে নামকরা গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য। রোগীদের ধারণা, তার কাছে গেলেই পেটের রোগের ভালো চিকিৎসা মিলবে। কিন্তু তার ‘সিরিয়াল’ পাওয়া দুরূহ। এ নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের আক্ষেপের শেষ নেই।

চিকিৎসা অঙ্গনে কিংবদন্তী হয়ে ওঠা ৫৮ বছর বয়সী এই চিকিৎসকের মুখোমুখি হয়েছিল চট্টগ্রাম প্রতিদিন। তার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, চিকিৎসা পেশা ছাড়াও নানা বিষয়ে তিনি বলেছেন খোলামেলা কথা। দীর্ঘ এই আলাপচারিতায় এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বেসরকারি খাতে চিকিৎসাসেবাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নই জানিয়েছেন বারেবারে।

যেভাবে বেড়ে ওঠা

শামীম বকসের জন্ম ১৯৬৪ সালের ২৫ জুলাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ৪ বোন ও ৩ ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় তিনি। বাবা খোদা বখস ছিলেন অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা। মায়ের নাম আফরোজা বেগম।

বাবার চাকরির সুবাদে নোয়াখালী, ফেনী, ফরিদপুর, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে শামীম বকস্কে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি পড়েছেন ফেনীতে। ১৯৭৯ সালে এসএসসি পাস করেছেন ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে। ১৯৮১ সালে এইচএসসি পাস করেছেন ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে।

বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ডাক্তারির পথে

চিকিৎসাবিদ্যায় পড়ার পেছনের ইতিহাস বলতে গিয়ে ডা. শামীম বকস্ জানালেন, তিনি ডাক্তার হবেন— এটাই চেয়েছিলেন তার বাবা-মা। তবে বেশি ইচ্ছে ছিল মায়ের। কারণ মায়ের বড় মামা ডাক্তার ছিলেন সেনাবাহিনীর। শামীম বকস্ বললেন, ‘মা চেয়েছিলেন মামার মতই আমিও বড় ডাক্তার হবো।’

সৌভাগ্য থাকলে যা হয়, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় টিকে শামীম বকসের ঠিকানা হলো পছন্দের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেই। সময়টা তখন ১৯৮২ সাল। ফার্স্ট ইয়ার ও সেকেন্ড ইয়ারজুড়ে থাকতেন নাসিরাবাদ পামরোজ হোস্টেলে। থার্ড ইয়ারে এসে হোস্টেলে সিট পেলেন। যদিও প্রথম প্রথম মন খারাপ হয়েছে হোস্টেলের খাবারের মান দেখে। বাড়ির কথা মনে পড়তো। পরে সেসব ভুলে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি। কারণ তার লক্ষ্যই ছিল ভালো একাডেমিক রেজাল্ট। পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার কারণে হলে ছাত্ররাজনীতি করা হয়নি তার। তবে ছিলেন তবলীগের মেহনত।

ছয় বছর পর ১৯৮৮ সালে এমবিবিএস পাস করে বের হন শামীম বকস্। পরের দু’বছর চট্টগ্রামে প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরি এবং বিকেলে চেম্বারে রোগী দেখতেন। পাশাপাশি বিসিএসের জন্যও প্রস্তুতি নিতেন।

কর্মজীবনের শুরু

১৯৯১ সালে বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন তিনি। পোস্টিং হয় ফেনী সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে দু’বছর থাকার পর পিজি হাসপাতালে মেডিসিনে এফসিপিএস শেষ করেন। এরপর ২০০০ সালে কনসালট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। ২০০১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে রেজিস্ট্রার হিসেবে বদলি হন। তিন বছর সেখানে থাকার পর ২০০৪ সালে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে বদলি করা হয় তাকে। সেখান থেকে এমডি কোর্স করতে আবার পিজি হাসপাতালে চলে যান। তিন বছর পর ২০০৭ সালে শেষ হয় এমডি কোর্স।

সরকারি চাকরির বাঁধাধরা নিয়ম তাকে টানলো না। ফলে সিদ্ধান্তও আগেই নেওয়া ছিল। এমডি কোর্স শেষ হওয়ার পর শেষমেশ সরকারি চাকরি ছাড়লেন শামীম বকস্। স্বাধীনভাবে বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালে কাজ করতেই তিনি সরকারি চাকরি ছাড়তে দ্বিধা করেননি।

সেই স্মৃতি টেনে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে শামীম বকস্ বললেন, ‘আমি যখন সরকারি চাকরি ছাড়ি, তখন প্রাইভেট সেক্টর খুব অবহেলিত ছিল। অথচ প্রাইভেট সেক্টরে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ থাকে। পোস্টিং নিয়ে টানাহেঁচড়া থাকে না।’

তিনি বলেন, ‘ন্যাশনাল হাসপাতাল ও সিএসসিআর হাসপাতালে আমি কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করি। দীর্ঘদিন পেরিয়ে বর্তমানেও এই দুই হাসপাতালেই আমি কাজ করছি।’

সেবা দেওয়ার চেষ্টায় তিন যুগ

শামীম বকস্ বলেন, ‘বিদেশের সেমিনারে যখন অংশগ্রহণ করতাম, তখন দেখতাম অংশগ্রহণকারী চিকিৎসকরা বিশেষ একটা বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সেই অভিজ্ঞতার সম্মিলিত প্রয়াসে কয়েকজন মিলে প্রাইভেট হাসপাতাল তৈরি করেন। বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মিলে একটা নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। একা একা সেটি তৈরি করা যায় না। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ইফিসিয়েন্ট ডাক্তার আছেন। কিন্তু প্রাইভেট সেক্টরে তার ঘাটতি রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি যেখানেই যে সেবা নিক, সে তো বাংলাদেশেরই নাগরিক। ভালো সেবা পাওয়ার অধিকার সব নাগরিকেরই আছে।’

নিজের দীর্ঘ চিকিৎসাজীবনের কথা বলতে গিয়ে ডা. শামীম বকস্ বলেন, ‘আমি ১৫ বছর ধরে রোগীদের শুধু ভালো সেবা দেওয়ারই চেষ্টা করছি। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। দেশে গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি চিকিৎসার ঘাটতি থাকায় আমি এর ওপরই এমডি কোর্স করেছি।’

শতকরা ৮০ ভাগই ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন

অতীত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘আগে সরকারি হাসপাতালগুলোতে রক্ত বমি হয়ে রোগী মারা যেত। কিন্তু কী কারণে এটি হল তা সবসময় চিহ্নিত করা যেত না। আমি সবসময়ই আমার সাবজেক্ট ছাড়াও বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করেছি। ন্যারো টানেল বা সংকীর্ণ ক্ষেত্র থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেছি। যেমন একজন রোগীর রক্তবমি হচ্ছে। তখন আমি রোগীর পেট ছাড়াও মাথা, কিডনি, হৃদযন্ত্র বিভিন্ন বিষয়গুলোও এক্ষেত্রে চিন্তা করব। আমি লিভার ও গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট মানে শুধুই পেটের ডাক্তার— তা কিন্তু নয়। আমি এক্ষেত্রে বৃহৎ ক্ষেত্র থেকে সংকীর্ণ ক্ষেত্রে আসব। চিকিৎসাপদ্ধতির পরিমাপ আমি সেভাবেই করব।’

বিষয়টি আরও ব্যাখা করে ডা. শামীম বকস্ বলেন, ‘আমার কাছে মাঝে মাঝেই এমন কিছু রোগী আসে যারা কিনা অজ্ঞান হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে আমরা এটাকে নিউরো মেডিসিন রিলেটেড রোগই ভাববো। কিন্তু সেটি সবসময় না। অনেক সময় লিভার ফেইলর হয়ে গেলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। এমনকি লিভার সিরোসিস হলেও রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তাই প্রথমেই আমি রোগীর কেস হিস্ট্রিটা জানি। আমার চিকিৎসাপদ্ধতিতে ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন শতকরা ৮০ ভাগ ও ইনভেস্টিগেশন শতকরা ২০ ভাগ।’

তিনি বলেন, ‘তিনটি ক্যাটাগরি দিয়ে রোগ নির্ণয় করতে হবে। সিম্পটোম্যাটিক বা লক্ষণজনিত রোগ দেখেও ইমার্জেন্সি চিকিৎসা দেওয়া হয়। যেমন পেট ব্যাথা মানেই গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা নয়। কারণ নির্ণয় করেই তারপর রোগীকে ওষুধ খেতে হবে।’

ডা. শামীম বকস্ বলেন, ‘রোগীর সঙ্গে সহজ হতে রোগী কোন্ জেলার লোক, সেই জেলার ভাষায় কথা বলতে হবে। আবার অঞ্চলভিত্তিক কিছু রোগ থাকে, সেটিও দেখেও রোগ নির্ণয়ের প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। যেমন রোহিঙ্গাদের লিভারের সমস্যা বেশি থাকে। অঞ্চলভিত্তিক রোগের প্রাদুর্ভাব রোগীর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তাই সিম্পটোম্যাটিক চিকিৎসা বেশি কার্যকর। আর তার চিকিৎসাপদ্ধতিতে এই থিওরিটা বেশ কার্যকর।’

দিনের শেষে পরিবারের সঙ্গ

১৯৮৯ সালে শামীম বকস্ বিয়ে করেন উম্মে কুলসুমকে। পারিবারিক সম্মতিতে হওয়া সেই বিয়ের কনে তখন মাত্রই এসএসসি পাশ করেছেন। ৩৩ বছরের সংসারজীবনে ছেলে তাদের একটিই। নাম সাদ বকস। বাবার পথ ধরে তিনিও পেশায় ডাক্তার। চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল থেকে পাস করে এফসিপিএস করছেন এখন।

ব্যক্তিগত ও দাম্পত্য জীবনের কথা বলতে গিয়ে শামীম বকস্ বলেন, ‘ভালো কাজের প্রেরণায় পরিবারের একটা বড় ভূমিকা থাকে। সেটি আসলে জীবনসঙ্গী। আমি ডাক্তার হয়েও এসএসসি পাস করা মেয়েকে বিয়ে করেছি। কারণ বিয়ের আগে তাকে দেখে মেনে হয়েছিল সে ধার্মিক। আমার চলার পথের সহায়ক একটা শক্তি হবে সে। হয়েছেও তাই। আমার স্ত্রী বুঝদার। এক হাতে সংসার সামলেছে। ছেলেকে সে-ই পড়িয়েছে। হাসপাতাল ও চেম্বার করে যখন রাত একটা-দেড়টায় বাসায় যাই, দেখি আমার স্ত্রী খাবার না খেয়ে আমার জন্য বসে আছে। জেগেই থাকে, আমি যতক্ষণ বাসায় না যাই। রাতের খাবার আমরা একসাথে খাই।’

তাবলিগ আছে জীবনের সঙ্গে মিশে

চিকিৎসাপেশার বাইরে ডা. শামীম বকসের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়— তাবলিগ। সেই অধ্যায়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘তাবলিগে যাওয়ার পর আমার জীবনে একটা বড় পরিবর্তন আসে। তখনই আমার মনে হয়েছিল আমার দ্বীনদার-ধার্মিক স্ত্রী প্রয়োজন। এ চিন্তা থেকেই এ বিয়ে।’

বর্তমান কর্মব্যস্ততার কথা বলতে গিয়ে শামীম বকস্ বলেন, ‘আমার ব্যস্ততা সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্তই। ভোরে নামাজ শেষ করে ঘন্টাখানেক দ্বীনের কাজ করি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফ্রেশ হয়ে সকালের খাবার খেয়ে ১০টার মধ্যেই বাসা থেকে বের হই। দুপুরে হাসপাতালেই খেয়ে নিই। এরপর পোস্ট অপারেটিভ রোগী দেখা, চেম্বার, অন কলে যাওয়া নিয়েও ব্যস্ত সময় পার করতে হয়।’

‘সিরিয়াল’ পাওয়া যেন সোনার হরিণ!

নিজের চেম্বারে ডা. শামীম বকসের রোগী দেখার কথা ২০ জন। তবে সিরিয়াল থাকে ৩০ জনের মতো। বাকি আরও ২০ জন রেফারেল হয়। সবমিলিয়ে বৃহস্পতি ও শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন ৫০ জনেরও বেশি রোগী দেখে থাকেন তিনি।

রোগীদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়, শামীম বকসের ‘সিরিয়াল’ পাওয়া সোনার হরিণ কিংবা অমাবস্যার চাঁদ। তবে রোগীদের এমন অভিযোগ মানতে নারাজ তিনি। শামীম বকস্ বলেন, ‘লন্ডনে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক দেখাতে চাইলে ৮ থেকে ৯ মাস আগে সিরিয়াল পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে সামান্য জ্বর-সর্দি-কাশিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে খুঁজি। আর এজন্যই গুরুতর রোগী সিরিয়াল পায় না।’ এজন্য তিনি রেফারেল সিস্টেমটা কার্যকর না হওয়ার কারণটাকেই দায়ী করেন।

বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, ‘সামান্য জ্বর-সর্দি-কাশি নিয়ে আমার কাছে আসার দরকার নেই। রেফার্ড করা রোগীদেরই আমি দেখতে চাই। স্থানীয় কোনো জেনারেল প্র্যাকটিশনারকে দেখানোর পর সংশ্লিষ্ট সেই রোগীকে যদি ডাক্তার রেফার্ড করেন, তবেই আমি সেই রোগীকে দেখতে চাই।’

তার ‘সিরিয়াল’ নিয়ে রোগীদের হয়রানি এবং এ নিয়ে একটি অসাধুচক্রের বাণিজ্য নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়গুলো আমার কানেও এসেছে। কিন্তু রোগীরাও আমাকে অভিযোগ দেয় না। এরকম হয়রানি হলে আমাকে চেম্বারে এসে রোগীরা জানাতে পারবে।’

তবে সিরিয়ালের বিষয়ে কিছু নতুন পদক্ষেপ নিতে চান বলে জানান ডা. শামীম বকস্।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!