চেনা হাসপাতালে অচেনা হাহাকার, করোনা আতঙ্কে রোগী আসছে না চমেকে

করোনা আতঙ্কের ছাপ পড়েছে চট্টগ্রাম নগরীর হাসপাতালগুলোতে। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে উল্টো করোনা সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে অন্যান্য ব্যাধি নিয়ে হাসপাতালমুখো হচ্ছেন না সাধারণ লোকজন। খুব জরুরি না হলে রোগীদের হাসপাতাল এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরাও। অন্যদিকে সড়কে চলাচল অনেকটা কম থাকায় তুলনামূলক কমেছে সড়ক দুর্ঘটনা। ফলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কিছুটা হলেও কমেছে চাপ। এদিকে রোগীদের অনেকেই খুব বেশি জরুরি না হলে বাসা থেকেই নিচ্ছেন ফোনে চিকিৎসকের পরামর্শ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে স্বাভাবিক সময়ে রোগীর সংখ্যা থাকে কমপক্ষে ২৫০ থেকে ৩০০ জন। কিন্তু বর্তমানে প্রতিটি ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি আছে প্রায় ৪০ জন থেকে ৬০ জন। মেডিসিন বিভাগের ১৩, ১৪ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা থাকতো সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখন বর্তমানে এর ২০ শতাংশ রোগীও নেই সেখানে। বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) দেখা গেছে, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি আছে ৫৫ জন, ১৪ নং ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি আছে ৫৭ জন এবং ১৬ নং ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ৪০ জন। এছাড়া ৮নং শিশু ওয়ার্ডে রোগী আছে ৫০ থেকে ৬০ জন, ৯ নং ওয়ার্ডে আছে ৮০ থেকে ১০০ জন। এই দুই ওয়ার্ডে আগে রোগী ভর্তি থাকতো ২০০ থেকে ২৫০ জনের মতো। অন্যান্য ওয়ার্ডগুলোরও অবস্থা প্রায় একই। তাছাড়া গাইনি ওয়ার্ডগুলোতেও আগের চেয়ে প্রায় ৫০ ভাগ রোগীর চাপ কমে গিয়েছে। যেখানে ৩০০ থেকে ৪০০ জন রোগী ভর্তি থাকতো, সেখানে এখন ১৫০ থেকে ২০০ জন রোগী ভর্তি আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মচারী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যখন থেকে চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে, তখন থেকে রোগীর সংখ্যাও কমে গেছে। আগে বারান্দায় পর্যন্ত রোগী এসে গাদাগাদি করতো। কিন্তু এখন বারান্দা তো খালিই, ওয়ার্ডের ভেতরেও বেড খালি থাকে। এছাড়া রোগী আসলেও ডাক্তাররা তাদের ওষুধ লিখে দিয়ে ছেড়ে দেন। রোগীর অবস্থা একদম বেশি খারাপ হলে তাকেই ভর্তি নেয়। অন্যথায় নেয় না। এই এক কারণে রোগী কমেছে। আবার অনেকে করোনার ভয়ে হাসপাতালে আসে না। এ কারণেও রোগী কমে গেছে।’

হাসপাতালের আরেক কর্মচারী বলেন, ‘রোগীর অবস্থা খারাপ হলে কয়েকদিন আগেও তাদের ভালোভাবে চিকিৎসা করাতো না ডাক্তার-নার্সরা। কিন্তু এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডাক্তার-নার্সদের সতর্ক করলে তারা এখন মোটামুটি রোগীদের ভালোভাবে চিকিৎসা করাচ্ছেন।’

হাসপাতালে বাবার চিকিৎসা নিতে আসা রাইয়ান নামের এক তরুণের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণেই আমাদের সকলের মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। যে জায়গায় আসলে ভয় কাটতো, মনে জোর আসতো— সেই জায়গায় আসলে মনে এখন ভয় কাজ করে। আমার আব্বুর অসুস্থতার কারণেই বাধ্য হয়ে হাসপাতালে এসেছি। তারপরেও ভয় হচ্ছে। নিজেদের সুরক্ষিত রাখতেই ডাক্তারদের পরামর্শে আব্বুকে নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করছি। কারণ এখানে ভর্তি থাকলে কোন্ সময় কিভাবে করোনায় সংক্রমিত হয়ে যাবো নিজেও বুঝে উঠতে পারবো না। তাই নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনতে চাই না।’

চমেক হাসপাতাল ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক আলাউদ্দিন তালুকদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জরুরি বিভাগেও রোগীর চাপ কমে গেছে অনেক। আগে সড়ক দুর্ঘটনায় এবং অন্যান্য দুর্ঘটনায় ২৪ ঘন্টায় জরুরি বিভাগে রোগী আসতো সর্বনিম্ন ৭০ জন থেকে ৮০ জন। কিন্তু এখন ২৪ ঘন্টায় আসে ৪ জন থেকে ৫ জন। কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সরকার সব ধরনের যানবাহন বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে সড়কপথ এখন খালি। তাছাড়া রাস্তায় ও মানুষের খুব একটা চলাফেরা নেই। তাই সড়কপথে দুর্ঘটনাও কম ঘটছে। তখন সারাদিন আমরা এসব দুর্ঘটনার শিকার আহত-নিহতদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। এখন কিছুটা ব্যস্ততা কমেছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘হাসপাতালে আগের চেয়ে রোগী কম— এটি আসলেই সত্য। এমনিতে আমাদের প্রতিদিন রোগী আসতো প্রায় ৩ হাজার। কিন্তু এখন রোগী আসে প্রায় ১৩ শতের মতো। আজকে রোগী এসেছে ১১শত ৫৯ জন।’

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘মূলত মানুষের মনে করোনার ভয় ঢুকে গেছে। সকলের মধ্যে ভয়ভীতি কাজ করছে। বাইরে বের হলেই প্রশাসনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে। এসকল ঝামেলায় না পড়ার চিন্তা থেকেও অনেকে হাসপাতালে আসছেন না। তাছাড়া হাসপাতালে এখন ওইসব রোগীরাই আসছে যাদের না আসলে একদম চলছে না।’

বারান্দা তো খালিই, ওয়ার্ডের ভেতরেও বেড খালি থাকে।
বারান্দা তো খালিই, ওয়ার্ডের ভেতরেও বেড খালি থাকে।

চমেক হাসপাতালের এই পরিচালক আরও বলেন, ‘আমাদের চারটি টেলিমেডিসিন হেল্পলাইন আছে। সেখানে ডাক্তাররা ২৪ ঘন্টা অনলাইন সেবা দিয়ে থাকেন। এর ফলে অনেকে ফোন করেই সেবা নিয়ে থাকেন। যার ফলে আর হাসপাতালে আসতে হচ্ছে না। আপৎকালীন সময়ে আমি প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের প্রধানদের নিয়ে দুই একদিন পর পর কনফারেন্স করি। সেখানে আমি তাদের বলি সত্যিকারের যারা শারীরিকভাবে বেশি অসুস্থ এবং যাদের হাসপাতালে ভর্তি করাতেই হবে শুধুমাত্র তাদের যেন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এরপর যাদের ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার মত হবে তাদের যেন ছেড়ে দেয়। দরকার হলে তারা পরে টেলিফোনে যোগাযোগ করবে। এরপর যে সমস্ত রোগীদের অপারেশন ২ মাস বা ৩ মাস পর করলে হবে, তাদের বলা হয় বাসা থেকেই ততদিন যাতে নিয়মমাফিক ওষুধ খায় এবং শরীরের যত্ন নেয়।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিশেষ করে যাদের লিভারে সমস্যা আছে, প্রেগনেন্সির রোগী— এরা তো আসেই। কারণ এদের তো বাসায় চিকিৎসা চালালে হবে না, হাসপাতালে তো আসতেই হবে। তাই তারাই আসে। গত পরশু দিনও (মঙ্গলবার) ২১ জনের সিজার হয়েছে। এছাড়া হার্টের রোগীরা এনজিওগ্রাম করতে আসে। অনেক রোগীর ডায়ালাইসিস করা হয়। এসব রোগীরা প্রতিদিনই আসে। আরও একটি নতুন খবর হচ্ছে শনিবারে হাসপাতালে থার্মাল স্ক্যানার বসানো হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!