চট্টগ্রামে পুলিশ-আসামির চুক্তি, ব্যবসাও চলছে সিএমপি দপ্তরের ভেতরেই

চোরাইপণ্যের দুই মামলার আসামি ব্যবসা করছেন খোদ চট্টগ্রাম নগর পুলিশের চোখের সামনেই। ‘নিরাপদ ব্যবসা’ চালাতে শোরুম ও রেস্টুরেন্টের জন্য চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) সঙ্গে ওই আসামির রয়েছে ৫ বছরের চুক্তিও। সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন সিএমপির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা এমন তথ্য শুনে ওই কর্মকর্তা নিজেও হতবাক হয়েছেন।

জানা গেছে, খোদ পুলিশের সঙ্গে ব্যবসায়িক (ভাড়ানামা) চুক্তির করে সেটাকেও নিজের নানা অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন দুই মামলার ওই আসামি। কথায় কথায় তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের নাম ভাঙান। সময়ে সময়ে ভয়ও দেখান অনেককে। সিএমপির কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিজের আত্মীয় হিসেবেও পরিচয় দেন কখনও কখনও।

পুলিশের সঙ্গে চুক্তি করা ওই আসামির নাম মো. হুমায়ুন কবির। পিতার নাম তোফাজ্জল হোসেন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের সামনেই পুলিশের জায়গাতেই তিনি গড়ে তুলেছেন ‘এস্টোরিয়ন’ নামে একটি কাপড়ের শোরুম। এর ওপরে রয়েছে তার আরেক ব্যবসা। ওই প্রতিষ্ঠানের নাম গ্র্যান্ড মোগল রেস্টুরেন্ট। অথচ এই রেস্টুরেন্টের লাগোয়া রয়েছে সিএমপির সিএমপির সদর দপ্তর ছাড়াও একটি ফুয়েল স্টেশন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব ব্যবসা চালাতে হুমায়ুন কবির চট্টগ্রাম নগরীর ওয়াসা এলাকায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের সামনেই তিনতলা একটা ভবন ভাড়া নেন। আর ভাড়া নিয়ে ব্যবসা চালাতে নগরীর ইপিজেড থানার দুই মামলার আসামি হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে চুক্তি করেন সিএমপির উপ কমিশনার (সদর) আমির জাফর। তবে এই স্বাক্ষর করেছেন তিনি সিএমপি কমিশনারের পক্ষে। অথচ সিএমপির জায়গায় ওই ভবন বানাতে গিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কোনো অনুমোদনও নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আশ্চর্যজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। আমি জানি না এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটেছে কিনা। এটা অভূতপূর্ব অনিয়ম।’

তিনি বলেন, ‘হতাশাব্যঞ্জক এ কারণে— আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা তাদের সম্পত্তিতে ব্যবসার জন্য চুক্তি করেছে আইনলঙ্ঘনকারী ব্যক্তির সঙ্গে। যার বিরুদ্ধে দুটি চোরাই পণ্যের মামলা আছে এবং ওই ব্যক্তি আসামি হিসেবেও অভিযুক্ত। এমন ব্যক্তির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিজস্ব সম্পত্তিতে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়াটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ও গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বে অবহেলাকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এই চুক্তিপত্রের মাধ্যমে অসাধুকে, অনৈতিকতাকে এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করল সিএমপি। এটা যেভাবেই পুলিশ কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা দেয় না কেন—যদি বলা হয় যে তারা মামলার বিষয়টা জানত না, এটাও তাদের অদক্ষতার পরিচায়ক। কারণ এটা পুলিশের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।’

তিনি বলেন, ‘এখানে আরেকটা প্রশ্ন উঠতে পারে—সিএমপি সত্যিকার অর্থে না জেনে এটা করেছে, নাকি কোন যোগসাজশের অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে— সেটাও কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা উচিত।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে সিএমপির ইপিজেড থানায় চোরাই পণ্য বেচাকেনা ও মজুদের দুটি মামলা রয়েছে। ওই দুই মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছে আরও কয়েকজনের নামও। মামলার পর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে চোরাই পণ্য মজুদ ও বেচাকেনার চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওঠে আসে এই হুমায়ুন কবিরের নামও। ঢাকায় হুমায়ুন কবিরের মালিকানাধীন এস্টোরিয়ন নামের শোরুম থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল চোরাই পণ্য। পুলিশ এই দুই মামলার অভিযোগপত্রও আদালতে জমা দিয়েছে ২০১৫ সালেই। অভিযোগপত্রে দুটি ধারা উল্লেখ করা হয়। ধারাগুলো হচ্ছে ৪১৩ ও ৪১১। মামলাগুলোর মধ্যে জিআর মামলা নম্বর ১৫০/১৫ চট্টগ্রামের চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন। অপর জিআর মামলা নম্বর ১৪৫/১৫ চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পঞ্চম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

আদালত সূত্রে জানা জানা যায়, মামলা দুটি করেছে চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেডে অবস্থিত দুটি কারখানার কর্তৃপক্ষ। এ মধ্যে একটির বাদি কর্ণফুলী স্পোর্টস ওয়ার ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেডের এডমিন ম্যানেজার তৌহিদুল ইসলাম এবং অপর মামলার বাদি তিতাস স্পোর্টস ওয়ার ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেডের এডমিন ম্যানেজার মনির হোসেন মজুমদার।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জিয়া আহসান হাবীব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘৪১৩ ও ৪১১— এই দুই ধারাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর মধ্যে ৪১৩ ধারামতে অভ্যাসগতভাবে চোরাই মালামাল বেচাকেনার জন্য হেফাজতে রাখা এবং ৪১১ ধারামতে চোরাই পণ্য জেনেও হেফাজতে রাখা।’

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (সদর) আমির জাফরকে ফোন করা হলে তিনি শুনেই বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। এটি যাচাইবাছাই করে দেখবো। এরপর কারোর সংশ্লিষ্টতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে অভিযুক্ত হুমায়ুন কবিরের মুঠোফোনে কল করা হলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমার মামলা নিয়ে আপনার জেনে কী লাভ? অপেক্ষা করেন, আমি সিএমপির কমিশনারকে এক্ষুণি জানাচ্ছি। ওনি আপনাকে ফোন করবে।’

এ কথা বলে তিনি সংযোগ বিছিন্ন করার পরপরই এই প্রতিবেদকের মুঠোফোনে কল আসে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এক গোয়েন্দা কর্তার। শুরুতেই হুমায়ুন কবিরকে ফোন করার বিষয়ে জানতে চান তিনি। এরপর তিনি নিউজটি না করার অনুরোধ জানান এবং বলেন, ‘হুমায়ুন কবির এখন ঢাকায়। তিনি আমার আত্মীয়ের মতোই। ঢাকা থেকে আসলে তিনি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!