চট্টগ্রামে গার্মেন্টসকর্মীদের ‘বিয়ে’ যেন ছেলেখেলা, সংসার যেন তাসের ঘর, বিচ্ছেদ প্রতিদিনই

গর্ভপাতের ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্য, গর্ভেই হয় শিশু বেচাকেনাও

চট্টগ্রাম ইপিজেডের গার্মেন্টসে কাজ করেন ভোলা জেলার বাসিন্দা আনোয়ার ও আশা সুলতানা। ভালোবেসে বিয়ে করার মাত্র দুই বছরের মাথায় ভেঙে যায় তাদের সংসার। স্ত্রীর সারাক্ষণ মোবাইলে কথা বলা, অফিস ফাঁকি দিয়ে পরপুরুষের সাথে বেড়াতে যাওয়া, সংসারের প্রতি দায়িত্বহীনতা এবং পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত থাকার অভিযোগে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে তাদের সংসার ভেঙে যায়।

দীর্ঘদিনের সাজানো-গোছানো সংসার, পারিবারিক বন্ধন, ফুটফুটে সন্তান, মধুর সম্পর্কের বাঁধনে ঘেরা স্মৃতি— কোনো কিছুই বাস্তবে পোশাককর্মীদের বিবাহ-বিচ্ছেদকে আটকাতে পারছে না। দাম্পত্য সম্পর্কগুলো দিন দিন ‘তাসের ঘরে’র মতো ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর-পতেঙ্গা-ইপিজেড এলাকায় বসবাসরত গার্মেন্টসকর্মীদের মধ্যে এখন তালাকের ঘটনা যেন ডালভাত। সংসারে লেগেই থাকছে কলহ-বিবাদ। গত কয়েক বছরে এরকম পারিবারিক কলহের জেরে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে বেড়েছে আত্মহত্যা ও হত্যার প্রবণতা। ঘটেছে পিলে চমকানো নৃশংস ঘটনাও।

গ্রামের বাড়িতে ছেলেসন্তান থাকার পরও চট্টগ্রাম ইপিজেডের গার্মেন্টসে চাকরি করার সুবাদে বোন পরিচয় দিয়ে আরেক গার্মেন্টসকর্মী বিউটির সঙ্গে একই বাসায় থাকতেন মনির। এ সময় তাদের মধ্যে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা শারীরিক সম্পর্কেও জড়ান। একপর্যায়ে বিউটি মনিরকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মনির তার সাত বছরের কন্যা সন্তান থাকায় বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিলেন না। বিউটি বিষয়টি বুঝতে পেরে তার নিজ সন্তান হোসনে আরা আক্তার ইলমার ওপর শুরু করেন শারীরিক নির্যাতন। কথায় কথায় তাকে মারধর, দেয়ালে মাথা ঠোকানোসহ নানা পাশবিক নির্যাতন শুরু করেন। নির্যাতনে তার হাঁটা-চলার শক্তিও চলে যায়। বিউটির পরামর্শে মনির নিজেও ওই শিশুটিকে নির্যাতন করেন। এভাবে শিশুটির উপর নির্যাতন চালানোর বিষয়টি টের পেয়ে দুজন বাড়িওয়ালা তাদের বাসা থেকে বের করে দেয়। এরপরও শিশুটির ওপর নির্যাতনের মাত্রা কমাননি বিউটি। এমনকি শিশুটিকে সাগরপাড়ে নিয়ে গলাটিপে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেওয়ারও পরামর্শ দেন বিউটি। পরে বিউটির পরামর্শে শিশুটির পেটে প্রচণ্ড কিলঘুষি মারেন মনির। এর কিছুক্ষণের মধ্যে শিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ঘটনা আঁচ করতে পেরে শিশুটির মা বিউটিকে বাসা থেকে আটক করে স্থানীয় জনতা। পরকীয়া প্রেমিক মনির পালিয়ে গেলেও পুলিশ তাকে পরে বাগেরহাট থেকে গ্রেপ্তার করে। দুজনই ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন আদালতে।

পুলিশ জানিয়েছে, গার্মেন্টসকর্মী বিউটির দুইবার বিয়ে হয়, কোন সংসারই টেকেনি। শেষের সংসারে তার কোলজুড়ে আসে শিশু ইলমা। ইলমার বাবার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর শিশুটি তার মায়ের কাছেই থাকত। কিন্তু তৃতীয় বিয়ে করার জন্য নিজ কন্যাকেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

দুই ইপিজেডে আড়াই লাখ পোশাককর্মী

চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল সিইপিজেড ও কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন কেইপিজেডে কয়েক লাখ পোশাককর্মী কাজ করে থাকেন। এই দুই ইপিজেডের মধ্যে সিইপিজেডের ১৫১টি কারখানায় ১ লাখ ৬০ হাজার শ্রমিক কর্মরত। অন্যদিকে কর্ণফুলী ইপিজেডের ৫০টি কারখানায় প্রায় ৭৫ হাজার পোশাককর্মী কাজ করেন।

চট্টগ্রাম নগরীর নিউমুরিং রোডে বসবাসরত গার্মেন্টসকর্মী আয়েশা আক্তারের সঙ্গে চাকরি সুবাদে পরিচয় হয় আরেক গার্মেন্টসকর্মী মুজিবুর রহমানের। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। পরবর্তীতে তারা পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেন। বিয়ের মাত্র তিন মাসের মাথায় স্ত্রী জানতে পারেন তার স্বামীর সঙ্গে একাধিক নারীর সম্পর্ক রয়েছে আগে থেকেই। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে স্বামী এক লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। যৌতুকের জন্য প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করেন। কিন্তু চাহিদামতো টাকা না পেয়ে ইয়াবা-আসক্ত স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে কাপড় ইস্ত্রি করার আয়রন, বৈদ্যুতিক তার, লোহার পাইপ দিয়ে আঘাত করে মারাত্মক আহত করেন আয়েশা আক্তারকে। পরে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর মাধ্যমে খবর পেয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় আয়েশাকে উদ্ধার করে খুলশী থানা পুলিশ।

বিপরীতে উল্টো ঘটনাও আছে। ২০১১ সালে গার্মেন্টসকর্মী সাইফুলের সঙ্গে ২ লাখ টাকা কাবিনে রোজিনা বেগমের বিয়ে হয়। প্রায় ১১ বছর ধরে সেই সংসার চললেও তাতে লেগেই ছিল অশান্তি। সংসারের প্রতি স্ত্রীর উদাসীনতা, নিজের খেয়ালখুশিমতো চলাফেরা, স্বামীর অবাধ্যতা, পরামর্শ-অনুরোধে কর্ণপাত না করে বারবার তালাক চাওয়ার অভিযোগ আনেন সাইফুল। কোনোকিছুর বিনিময়ে যখন রোজিনাকে ফেরানো যাচ্ছিল না, তখন চলতি বছরের মাঝামাঝিতে সাইফুল বেছে নেন বিবাহবিচ্ছেদের পথ।

বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলে জানা গেছে, সংসার ভাঙার পেছনে গার্মেন্টসকর্মী নারী-পুরুষ একে অন্যকে দায়ী করলেও এর নেপথ্যে রয়েছে পারস্পরিক আস্থাহীনতা, সন্দেহ-অবিশ্বাস, পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, জুয়া ও মাদকাসক্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ভরণপোষণ না পাওয়া, সংসারের প্রতি স্ত্রীর উদাসীনতা ও অবাধ্যতা, স্বামীর বেকারত্ব ও অভাব-অনটন, যৌতুক দাবি। ফেসবুক-মেসেঞ্জার-ভাইবার-হোয়াটসঅ্যাপ-ইমোর মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করে নতুন সঙ্গী পেয়ে যাচ্ছেন নারী-পুরুষ উভয়েই। ফলে বাড়ছে পরকীয়ায় জড়ানোর ঘটনাও। চাকরি বাদ দিয়ে স্বামী থাকা অবস্থায় কোনো কোনো নারী নতুন কৌশলে সামাজিক যোগাযোগের অ্যাপে ‘গ্রুপ চ্যাটে’ যৌনতায় অংশ নিয়ে বিকাশের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করছেন। সবকিছু মিলিয়ে গার্মেন্টসে কর্মরত নারীরা আগের চেয়ে এখন বেশি স্বাবলম্বী। তালাকের পর কিভাবে চলবেন, তা নিয়ে সেভাবে ভাবতে হচ্ছে না। এতে তালাকের পথ বেছে নিতে দ্বিধায় পড়তে হচ্ছে না তাদের। ফলে দিন দিন বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ।

ইমো-ফেসবুক ঘিরে অচেনা মানুষ, প্রেমের সম্পর্ক

কাজের খোঁজে ছেলে ও মেয়েরা গ্রাম থেকে গার্মেন্টসের চাকরি নিয়ে এসে শহুরে জীবনধারায় অভ্যস্থ হওয়ার পর সেখানে যখন যোগ হয় প্রযুক্তি এবং মাস শেষে বেতন পাওয়ার হাতছানি— তখন তাদের বেশিরভাগের মধ্যেই ঘটে আমূল এক পরিবর্তন। কর্মক্ষেত্রে আসা-যাওয়ার পথে এদের অনেকেই জড়িয়ে পড়েন বন্ধুত্বে। ফেসবুক-ইমোর মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈরি হয় বিশেষ সম্পর্ক। আবার একই ভবনে থাকার সুবাদে অথবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় নিয়মিত দেখা ও যোগাযোগের কারণে তাদের মধ্যে ভালোলাগা থেকে ভালাবাসার জন্ম নেয়। এ ধরনের সম্পর্কে জড়ানোর আগে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো-মন্দ কোন কিছুর বিচার না করে, সত্যিকারের পরিচয় বা পারিবারিক অবস্থার খোঁজখবর না নিয়েই মন দেওয়া-নেওয়া শুরু করে দেয়। এমনকি সম্পর্ক তৈরি করতে চাওয়া পুরুষ বিবাহিত কি অবিবাহিত— সেটারও খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।

দেখা গেছে, পোশাককর্মীরা নিজেদের মধ্যে সম্পর্কে জড়ানোর শুরুতেই বেড়াতে যাওয়ার নামে রাতের অন্ধকারে প্রথমে সুযোগ খোঁজে সমুদ্র সৈকতের ঝোঁপঝাড়, পতেঙ্গা নেভাল, ডার্ক রেস্টুরেন্ট, শিশুপার্ক, আকমল আলী ঘাট কিংবা আনন্দবাজার সাগরপাড়ে। সেই সম্পর্ক আরেকটু গাঢ় হতেই তাদের অনেককে দেখা যায় ফয়’স লেকের রেস্টুরেন্টের ভাড়া কেবিন কিংবা ছোটখাট আবাসিক হোটেলে।

‘কোর্ট ম্যারিজের’ চুক্তিতে জীবন নিয়ে জুয়াখেলা

ধর্মীয় রীতিনীতি উপেক্ষা করে ‘কোর্ট ম্যারিজ’ মানেই বিয়ে— এমন ধারণা গার্মেন্টসকর্মীদের। কথিত ‘কোর্ট ম্যারিজ’ হলে তাদের আর আইনগত কোনো সমস্যা থাকবে না, কেউ তাদের বাধাও দিতে পারবে না— এমন ধারণা বা বিশ্বাসকে পুঁজি করে তারা দাম্পত্যজীবনে নামার পরিকল্পনা করেন। বাস্তবে কোর্ট ম্যারিজের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। এটি শুধুমাত্র এফিডেভিড বা হলফনামার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের ঘোষণামাত্র। এই ঘোষণাপত্রটি ২০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখে নোটারি পাবলিক করা হয়। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেও সম্পন্ন করা হয় অনেক সময়।

আইনজীবীরা বলছেন, মুসলিম বিয়েতে কাবিননামাই হল বিয়ের চুক্তিপত্র। আর আইনমতে বিয়ের ৩০ দিনের মধ্যেই নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। ৯০ দিনের মধ্যে এই এফিডেভিট বা হলফনামাটি অকার্যকর হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে ওঠে আসে, চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড এলাকায় বসবাসরত উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে আসা পরিবারগুলো তাদের কন্যাসন্তানদের ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। এফিডেভিট নামের ‘হলফনামা’ দিয়ে খুব সহজেই আদালতে উপস্থিত না হয়েও বাল্যবিয়ে করানো যায়। ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়ার কারণে হয় না কাবিননামা।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গার্মেন্টসকর্মীদের বেশিরভাগই হলফনামার ক্ষেত্রে আদালতে উপস্থিত না হয়ে ৮-১০ হাজার টাকার বিনিময়ে আইনজীবী, কথিত মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক ছাড়াও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে ‘কন্ট্রাক্টে’র মাধ্যমে বিয়ের ঘোষণাপত্র ঠিক করে। কৌশলে অনেক নাবালিকা মেয়ের বয়স নিয়েও চলে লুকোচুরি। অনেকেই আবার মসজিদ কিংবা মাজার সাক্ষী রেখে নিজে নিজেই বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে একসঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকে বছরের পর বছর ধরে। অবৈধ সম্পর্ক করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে তখন এলাকার মানুষ হুজুর এনে বিয়ে করিয়ে দেওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে অহরহ।

হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব এডভোকেট এএম জিয়া হাবীব আহ্‌সান বলেন, ‘বিয়ের মূল ভিত্তি হলো— কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন না করলে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার, মোহরানা, সন্তানের অধিকারসহ বিভিন্ন আইনের জটিলতা দেখা যায়। এখন হিন্দু আইনেও বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের বিধান রয়েছে। হলফনামা মূলে বিয়ের ৯০ দিনের মধ্যে কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন না করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশেষ করে কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন স্বামীরা করে থাকে। কাবিননামা না থাকলে পরবর্তীতে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী বিয়ের আশ্বাসে ধর্ষণ মামলা করতে পারে। তাদের সংসারে যদি কোন সন্তান থাকে তাহলে স্ত্রী ও সন্তানের অধিকারের বিষয়ে কাবিননামা রেজিস্ট্রেশনের জন্য আদালতে আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। অনেক সময় কাজী অফিসে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের বয়স কম হলে তারা রেজিস্ট্রেশন করাতে অস্বীকার করলেও কিছুদিন পর দেখা গেল কৌশলে এভিডেভিট বা হলফনামার মাধ্যমে বয়স গোপন করেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ভালো করে বয়স যাচাই-বাছাই না করে বিয়ে দেওয়া আইনগত অপরাধ।’

তিনি বলেন, ‘কিছু ভুঁইফোড় মানবাধিকারকর্মীর কারণে প্রকৃত মানবাধিকারকর্মীদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। ভূঁইফোড় মানবাধিকারকর্মীরা ভুক্তভোগীদের খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়। মীমাংসার কথা বলে উভয়পক্ষের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা ও কাবিননামার টাকা উদ্ধারের নামে রীতিমতো চাঁদাবাজি করছে। তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।’

বিবাহবিচ্ছেদে গার্মেন্টসকর্মীরাই শীর্ষে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনকারীদের মধ্যে ইপিজেড এলাকার গার্মেন্টসকর্মী নারীদের সংখ্যাই বেশি। এক্ষেত্রে প্রায় ৯০ শতাংশ নারী বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করছেন। বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে আবেদনকারীদের মধ্যে ইপিজেডের পরই আছে কালুরঘাট শিল্পাঞ্চল এলাকা।

চট্টগ্রামের একটি গার্মেন্টসে কর্মরত বাগেরহাট জেলার বাসিন্দা সুমাইয়া আক্তার মুন্নি ২০১৬ সালে ১ লাখ টাকা কাবিনে ভালোবেসে বিয়ে করেন সজিব হোসেনকে। সংসার জীবনে তাদের একটি ৪ বছরের কন্যাসন্তান রয়েছে। বিয়ের ৫ বছরের মাথায় তাদের দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ ঘটে। কারণ হিসেবে সুমাইয়া উল্লেখ করেছেন তার স্বামী তাকে কারণে-অকারণে সন্দেহ করেন, ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে সারাক্ষণ সংসারে ঝগড়াঝাটি ও মারামারি লেগেই থাকে। তার বাবা-মা-ভাই-বোন কাউকে স্বামী সহ্য করতে পারেন না।

মানবাধিকার সংগঠন আসক ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, সংস্থাটির চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ে প্রতি মাসে অর্ধশতাধিক বিবাহবিচ্ছেদের অভিযোগ জমা পড়ে। তার মধ্যে বেশিরভাগ অভিযোগই ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের। সংস্থাটির হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২-৩টি করে বিবাহবিচ্ছেদের অভিযোগ জমা পড়ছে। নগরীর বন্দরটিলায় কর্মরত অন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোতেও দিনে গড়ে বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়ে অন্তত দুটি করে। এর বাইরে স্থানীয় নারী উদ্যোক্তা, স্থানীয় নারী জনপ্রতিনিধি ছাড়াও পতেঙ্গাভিত্তিক অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন কাছেও বিবাহ বিচ্ছেদের অভিযোগ যায়।

বিবাহ বিচ্ছেদের অভিযোগকারী নারীরা চট্টগ্রামে কর্মরত থাকলেও তাদের বেশিরভাগেরই বাড়ি ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, বরিশাল, চাঁদপুরসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সালিশি আদালত ১ ও ২ নম্বর আদালতে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন জমা পড়ে ৫ হাজার ৮৬৭টি। এতে গার্মেন্টসকর্মীদের আবেদন সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে ১ হাজার ৩৪৬টিতে। অন্যদিকে উভয়পক্ষের সমঝোতায় মীমাংসা হয়েছে ১৫১টি।

বিয়ে যেন ছেলেখেলা, সংসার যেন তাসের ঘর

পোশাককর্মীদের অপরিণত বিয়ে নিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে এমনও দেখা গেছে, নারী ও পুরুষ দুজনই পরস্পরকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছেন। পুরুষের বেলায় দেখা যায়, একজন পুরুষের গ্রামে স্ত্রী-সন্তান থাকার পরেও সেই তথ্য গোপন রেখে কৌশলে কর্মস্থলে নারী পোশাককর্মীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বিয়ের আশ্বাসে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্কটাকে আরও পাকাপোক্ত করতে বাসা ভাড়া করে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে থাকেন বছরের পর বছর ধরে শুধুমাত্র যৌনচাহিদা মেটানোর জন্য।

দেখা গেছে, আইনি জটিলতা এড়াতে পুরুষ পোশাককর্মীরা হলফনামা করলেও কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন করার ক্ষেত্রে অবহেলা করেন। আবার হলফনামা ও কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন যদি করাও হয়, প্রায় ক্ষেত্রেই দেনমোহর ধরা হয় ৩০ হাজার থেকে বড়জোর ২ লাখ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, তালাকের বেলায় টাকা যেন স্বামীরা সহজেই পরিশোধ করতে পারে, দেনমোহরও সেভাবেই ধরে তারা।

বিয়ের নামে অভিনব সব প্রতারণার ঘটনায়ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল ভূমিকায় দেখা গেছে পুরুষ পোশাককর্মীদের। ব্যবসার নামে নারী পোশাককর্মী স্ত্রীকে ‘জামিনদার’ করে বেসরকারি আর্থিক সংস্থা থেকে মোটা অংকের টাকা ঋণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। অনেকে আবার বেকারত্বের অজুহাত দেখিয়ে কয়েক মাসের ঘরভাড়া, মুদির দোকান, কাঁচাবাজারের টাকা, প্রতিবেশী ও বন্ধুদের কাছ থেকে ধারদেনা করে স্ত্রীর ঘাড়ে দেনার বোঝা তুলে দিয়ে রাতের অন্ধকারে নগদ টাকা ও স্বর্ণ অলংকার নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এমন অবস্থায় তাদের খুঁজে পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ গার্মেন্টসে কর্মরত অনেক পুরুষকর্মীই অন্যজনের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, চেয়ারম্যান সাটিফিকেট ও ভোটার আইডি কার্ড ব্যবহার করে তথ্য গোপন করে।

বৈবাহিক প্রতারণার প্রবণতা রয়েছে নারী পোশাককর্মীদের মধ্যেও। এক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়ে নারীরা স্বেচ্ছায় পুরুষের সাথে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। উভয়ের সম্মতিক্রমেই তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। একটা সময় নারীরা বিয়ের জন্য চাপ দিলে পুরুষ যখন অনীহা প্রকাশ করে অথবা আগের ঘরের সংসারের স্ত্রী-সন্তানকে মেনে নিতে না পারেন, তখন পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করে দেন।

স্বামী থাকা অবস্থায় তানিয়া আক্তার নামের এক নারী পোশাককর্মী চট্টগ্রামে কর্মরত বরিশাল জেলার বাসিন্দা জসিম উদ্দিনের সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। জসিম তাকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেন। তানিয়া বারবার বিয়ের জন্য চাপ দিলে জসিম তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকেন। পরে তানিয়ার টাকাপয়সা ও স্বর্ণ অলংকার নিয়ে জসিম পালিয়ে যান। এ ঘটনায় চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি মানবাধিকার সংগঠন আসক ফাউন্ডেশনে অভিযোগ করেন তানিয়া।

অভিযোগ রয়েছে, অনেক নারী বিয়ের কাবিননামায় কৌশলে ৫ লাখ টাকার দেনমোহর ধার্য করে বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে স্বামীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে তাকে তালাক দিয়ে দেনমোহরের ৫ লাখ টাকা আদায় করে নেন। এমন ঘটনার শিকার হয়ে অনেক পুরুষ পোশাককর্মী বাড়ির ভিটেমাটি বিক্রি করে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন।

আবার দেখা যায়, নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হলে স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের মিথ্যা মামলা করেন অনেক নারী। পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে স্বামীর জমানো নগদ টাকা ও স্বর্ণ অলংকার নিয়ে নতুন প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও আছে। এমনকি পরকীয়া প্রেমের কারণে বৈধ স্বামীর সন্তানের ভ্রুণ নষ্ট করার ঘটনাও আছে।

চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেডের আকমল আলী রোডে সাম্প্রতিক সময়ে সালিসি বৈঠকে পোশাককর্মীদের সংসার ভাঙার দুটি ঘটনা চট্টগ্রাম প্রতিদিনের নজরে এসেছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংসারগুলো ভাঙার মূল কারণ ছিল অনলাইনে বিভিন্নভাবে জুয়া খেলে স্ত্রীর বেতনের সব টাকা খরচ করে ফেলেন বেকার স্বামীরা। শূন্য হাতে স্ত্রীরা ঋণগ্রস্থ হয়ে ঘরভাড়া, দোকানের বকেয়া, সংসারের খরচ সব মিলিয়ে দিন দিন পাওনাদারের সংখ্যা বেড়ে যায়। এভাবে একই চিত্র প্রতি মাসে। এ নিয়ে স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে পারিবারিক কলহ, মারধর, মান-অভিমান, সংসারের প্রতি তিক্ততার শেষ পরিণতি দাঁড়ায় বিবাহ-বিচ্ছেদে।

ইপিজেড এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মত রয়েছে বিভিন্ন মাল্টিপারপাস কোম্পানি। এসব কোম্পানির লোভনীয় প্রস্তাবে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা। সারাজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমের টাকা হারিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে প্রতিনিয়ত লেগে থাকে ঝগড়া ও মারামারি। কেউ কেউ গ্রামে জমি বিক্রি করে মাল্টিপারপাস কোম্পানিতে টাকা রেখে আজ নিঃস্ব। গার্মেন্টস কর্মী আমেনা বেগম অনেক কষ্ট করে স্বামীকে বিদেশ পাঠিয়ে ছিলেন সংসারের অভাব অনটন দূর হবে বলে। তার স্বামী ১০ বছর বিদেশে থেকে যে টাকা পাঠাতেন, স্বামীকে না জানিয়ে সেখান থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা রুপসা মাল্টিপারপাস কোম্পানিতে রেখে প্রতারণার শিকার হোন। স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে এ ঘটনা জানার পর আমেনা বেগমকে তালাক দেন।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট মনীষা মহাজন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝে ঘটছে বিবাহ বিচ্ছেদ। এখন সবচেয়ে বেশি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে ইপিজেড এলাকায়। তার মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি।

তিনি জানান, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সালিশি আদালত ১ ও ২ নম্বর আদালতে ২০২২ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ৫ হাজার ৮৬৭ টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৪৬টির ক্ষেত্রেই বিবাহ বিচ্ছেদ আটকানো যায়নি। মীমাংসা হয়েছে শুধু ১৫১টি অভিযোগ।

কেন টেকে না পোশাককর্মীদের সংসার

কর্মজীবী দম্পতির মধ্যে স্ত্রীর তুলনামূলক বেশি আয়ের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক বিষয়ের পাশাপাশি জীবন সন্তুষ্টি, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সম্পর্কচ্ছেদের মতো ঘটনাগুলোও যুক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে, যে স্বামী তার স্ত্রীর আয়ে পুরোপুরি নির্ভরশীল, তার মানসিক অবস্থা সবচেয়ে করুণ থাকে। স্ত্রীর রোজগার বেশি থাকায় স্বামী গুরুত্বহীন এবং কেউ কেউ স্বামীকে পাত্তাই দেয় না— এমনও অভিযোগ ওঠে আসে।

চট্টগ্রামে কর্মরত পোশাককর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক স্ত্রীর বেতন তোলার এটিএম কার্ড থাকে স্বামীর কাছে। স্ত্রী সারা মাস কষ্ট করে বেতনের সময় স্বামীরাই ব্যাংক থেকে টাকা তোলেন এবং নিজের ইচ্ছে মত স্ত্রীর বেতনের টাকা খরচ করে। এমনও অভিযোগ রয়েছে, স্ত্রীর বেতনের টাকা থেকে স্বামীরা প্রতিদিন ২০-৫০ টাকা হারে স্ত্রীকে হাতখরচের টাকা দেন।

আবার দেখা যায়, অনেক স্বামী তাদের স্ত্রীকে সন্দেহ করে অফিস ছুটির সময় কারখানার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। অফিস শেষে স্ত্রী কোথায় যায়, কার সাথে কথা বলে, বাসায় ফিরতে দেরি করে কেন— এমন সব প্রশ্ন আর সন্দেহে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। একইভাবে স্ত্রীও অনেক সময় তার স্বামীকে পাহারা দিতে কর্মস্থলের গেইটে গিয়ে অবস্থান নেন। উভয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ যখন সত্যি হয়, তখন রাস্তায় লোক জড়ো করে বাঁধে হট্টগোল।

পুরুষেরা অনেক সময় নিজেদের মানসম্মানের কথা ভেবে স্ত্রীর দেওয়া মানসিক, শারীরিক, যৌতুক ও নারী নির্যাতন মামলার ভয়ে কাউকে কিছু বলেন না। কারণে-অকারণে সন্দেহ করা, ঝগড়া করা, মোবাইল ফোন চেক করা, কথায় কথায় আত্মহত্যা বা গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভয় দেখানোসহ নানা কারণে কারণে অনেক স্বামী বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়ার পথ খোঁজেন। অন্যদিকে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেক নারী স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলেও নীরবে মেনে নেন। প্রথম স্ত্রীর সাথে স্বামী সংসার না করলেও স্ত্রী তাকে তালাক দেন না। স্বামীর মন চাইলে স্ত্রী-সন্তানের খোঁজখবর নেন, না নিলে নেই। দেখা গেছে, তালাকের পর অনেক স্বামী কিছুদিন সন্তানের ভরণপোষণ চালালেও একটা সময় তা বন্ধ করে দেন। ধীরে ধীরে আর কোনো খোঁজখবর রাখেন না সন্তানদের।

এমনও দেখা যায় প্রায়ই— বাসা ভাড়া সাশ্রয়ের জন্য একই ফ্ল্যাটে ২-৩টি পরিবার থাকার সুবাদে সেখানেই একজনের স্বামীর সাথে আরেকজনের স্ত্রী এবং আরেকজনের স্ত্রীর সঙ্গে অন্যজনের স্বামীর পরকীয়া ও অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবেও সংসার ভাঙছে অনেকের।

গর্ভপাতের ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্য, গর্ভেই হয় শিশু বেচাকেনাও

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড, পতেঙ্গা ও বন্দর এলাকায় বসবাসকারী পোশাককর্মীদের অনেকেই অপরিকল্পিত গর্ভধারণের কারণে শেষ পর্যন্ত গর্ভপাতের পথ বেছে নেন। এক্ষেত্রে তারা প্রথমে কোনো ফার্মেসিতে গিয়ে ভ্রুণ নষ্ট করার ‘ওষুধ’ ব্যবহার করে। ওই পথে কেউ কেউ ভ্রণ নষ্ট করতে পারলেও যারা বিফল হয়, তারা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নার্স কিংবা আয়ার পরামর্শ নেন। তারপর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পরিবার পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে এমআর (মিন্সট্রুয়াল রেগুলেশন) বা গর্ভপাত করান।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চট্টগ্রামে পোশাককর্মী অধ্যূষিত এসব এলাকায় গর্ভপাত করতে আসা মেয়েদের মধ্যে ১৬ বছরের কিশোরী থেকে মধ্যবয়স্ক নারীও রয়েছেন। বিয়ের আগে অনেকেই অনিরাপদ যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে লোকলজ্জার ভয়ে গোপনে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে গিয়ে গর্ভপাত করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোশাক কারখানার অল্পবয়সী নারীরাই বেশি আসেন গর্ভপাত করাতে।

নগরীর ইপিজেড, পতেঙ্গা ও বন্দর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আনাচে-কানাচে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গর্ভপাত করছে। অনেকে আবার হোমিও ও আয়ুর্বেদিক ‘চিকিৎসা’র মাধ্যমে গর্ভপাত ঘটাচ্ছে। নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মোটা অংকের টাকা নেওয়া হয়ে থাকে এসব ক্ষেত্রে। এমনও দেখা যায়, পাঁচ মাস থেকে সাত মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা নারীও আসেন গর্ভপাত করাতে।

চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ধরনের গর্ভপাত খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এমন অনিরাপদ গর্ভপাতের ফলে নারীর বন্ধ্যাত্ব, শারীরিক, মানসিক সমস্যাসহ অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণ, ইনফেকশন ও খাদ্যনালী ফুটো হয়ে গেলে মৃত্যুও হতে পারে।

ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত একজন দায়িত্বশীল নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে, গর্ভের সন্তান বড় হয়ে ভূমিষ্ট হলে মায়েরা যখন সন্তানদের পিতৃপরিচয় দিতে ব্যর্থ হন, তখন ক্লিনিকগুলোতে সবার অগোচরে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় মানবশিশু কেনাবেচা হয়। অনেক সময় ‘অবাঞ্ছিত’ শিশু মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই বিক্রি হয়ে যায় ক্লিনিকমালিকসহ কয়েক হাত ঘুরে।

বাংলাদেশের আইনে শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে মায়ের জীবন বাঁচাতে গর্ভপাতের সুযোগ আছে৷ তবে ধর্ষণ, শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক কারণ, ভ্রণের বিকলাঙ্গতা এসব কারণেও গর্ভপাত আইনসিদ্ধ নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এমআর-কে বৈধতা দেয় সরকার৷ আগে এমআর করার সর্বোচ্চ সময়সীমা ছিল আট সপ্তাহ, কিন্তু এখন ১২ সপ্তাহ৷ প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই এমআর-এর আলাদা বিভাগ আছে৷

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বহির্বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. জাকিয়া মমতাজ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমআরের জন্য নির্দিষ্ট সময় ও লিমিট আছে। একবার যদি দক্ষ হাতে এমআর না হয় তাহলে জরায়ু ভিতরে অনেক ধরনের ইনফেকশন হতে পারে। এমআর করাতে গিয়ে সরঞ্জামের সঠিক ব্যবহার না হলে জরায়ু ফুটো হয়ে যেতে পারে, টিউমারও হতে পারে, এমনকি ইনফেকশন থেকে পরবর্তীতে নারীদের সন্তান ধারনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের ঘটনা একেবারেই কমন।’

বাবা-মায়ের বিচ্ছেদে সন্তানদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ

গার্মেন্টসকর্মী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক হয়ে যাওয়ার পর সন্তান কার কাছে থাকবে তা নিয়ে দেখা দেয় নতুন সমস্যা। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মধ্যস্থতায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটি চুক্তি হতে দেখা যায় কখনও কখনও। সেক্ষেত্রে শর্ত রাখা হয়— সন্তান যদি মায়ের কাছে থাকে তাহলে তার ভরণপোষণ পিতাকেই চালাতে হবে, পিতা নিয়মিত সন্তানের সাথে যোগাযোগ ও দেখা সাক্ষাৎ করতে পারবে, ছেলে সন্তান হলে সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত সে তার মায়ের হেফাজতে থাকবে।

তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গার্মেন্টসকর্মী বাবা-মায়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানকে পাঠিয়ে দেন দাদা-দাদি কিংবা নানার বাড়িতে বা অন্য কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে। কর্মব্যস্ততার কারণে অনেকে আবার সন্তানকে সারাদিনের স্কুল কিংবা এতিমখানায় ভর্তি করে দেন। একটা সময় দেখা যায় পিতা-মাতা নতুন করে বিয়ের করার কারণে নতুন পরিবারেও তাদের জায়গা হয় না। বাবা-মা আগের মত খোজখবর নেয় না। বাড়ে দূরত্ব। তখন বেশিরভাগ শিশুরই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ছেলেশিশুরা বিভিন্ন ভাঙারির দোকান, চায়ের দোকান, মুদির দোকান, ওয়ার্কসপ, কাগজ ও বোতল কুড়ানো, জুতার কারখানায় শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি ঝুঁকে পড়ে মাদকসহ অপরাধমূলক নানা কর্মকাণ্ডে।

অন্যদিকে মেয়েশিশুদের অনেকে বাসাবাড়ি ও গার্মেন্টসে কাজ করার পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ে যৌনব্যবসায়। অল্প বয়সে হচ্ছে তাদের বাল্যবিয়েও। নতুন করে এভাবে জন্ম নেয় সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু। পিতা-মাতার বিবাহ বিচ্ছেদ পাল্টে দিচ্ছে এসব শিশুর জীবন। বেড়ে ওঠার বয়সটাতেই তারা সবসময় অন্যদের তুলনায় নিজেদের অসহায়, হীন ও ছোট মনে করে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সৌজন্যে তাদের কেউ কেউ স্কুলে গেলেও সেখানে মানসিক চাপের পাশাপাশি শারীরিকভাবে হেনস্তার শিকারও হয়— এমন অভিযোগও আছে। প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের কটু মন্তব্য শোনাও যেন তাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। পিতা-মাতা থাকার পরেও ওরা যখন এতিমের মতো বেড়ে ওঠে, তখন ওদের চোখে-মুখে পিতা-মাতার প্রতি ঘৃণা, ক্ষোভ আর অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা যা বললেন

পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন আলোকিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাপ্পী দেব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পোশাকশ্রমিকদের যে হারে দিন দিন বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে তাতে তছনছ হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি পরিবার। বিশেষ করে পরকীয়া, সন্দেহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সংসারের ভরণপোষণসহ বিভিন্ন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। সংসার জীবনে ছোটখাট বিষয়ে কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই ঘটে যায় হত্যা কিংবা অভিমানে আত্মহত্যার মতো বড় ধরনের দুর্ঘটনা। জটিল অভিযোগ সহজে মীমাংসা না হলে তখন অভিযোগগুলো মহিলা আইনজীবী পরিষদের কাছে নিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

তিনি বলেন, ‘পোশাকশিল্পে কর্মরত যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী শ্রমিকদের বয়ঃসন্ধিকালে তাদেরকে শারিরীক পরিবর্তন, মানসিক পরির্তন, সিদ্ধান্তহীনতা, দায়িত্ববোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা খুবই জরুরি। তবে এ ক্ষেত্রে গার্মেন্টসের মালিকপক্ষ, বেপজা, স্থানীয় কাউন্সিলর, এনজিও ছাড়াও পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে।’

নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ইপসার সামাজিক উন্নয়ন বিভাগের উপ-পরিচালক নাসিম বানু শ্যামলী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ’ইপসার পক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন গার্মেন্টসে এইচআইবিএইচ নিয়ে, লাইফ ওয়ার্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেছি। আগামীতে নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। গার্মেন্টসে কোন নারী যদি যৌন হয়রানির শিকার হয় অথবা বিয়ের আশ্বাসে ধর্ষিত হয় আমরা তাদের ন্যায়বিচার পেতে লিগ্যাল সাপোর্ট দিচ্ছি।’

জনপ্রতিনিধি যেভাবে দেখছেন

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিইপিজেড-কেইপিজেডসহ বিভিন্ন সরকারি বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে নগরীর অন্যান্য ওয়ার্ডের তুলনায় আমার ইপিজেড এলাকার ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে জনসংখ্যা বেশি। জীবন জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার নারী-পুরুষ সিইপিজেড ও কেইপিজেডে কর্মরত। প্রতিদিন ওয়ার্ড অফিসের কার্যালয়ে গার্মেন্টসে কর্মরত নারী শ্রমিকরা স্বামীদের অত্যাচার-পরকীয়াসহ নানা সমস্যা নিয়ে আসেন আমার কাছে। আমি যতটুকু জানি, প্রতিনিয়ত ভাঙছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংসার। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে গার্মেন্টসে কর্মরত নারী শ্রমিকরা পুরুষদের পরিবার পরিজন, গ্রামের ঠিকানা কোন কিছু যাচাইবাছাই না করে একই ফ্যাক্টরিতে চাকরির সুবাদে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে এ সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায়। প্রথম ২-৩ বছর তাদের সংসার জীবনে ফুটফুটে সন্তানসহ ভালো সময় কাটলেও পরে স্ত্রী জানতে পারে স্বামীর গ্রামের বাড়িতে আগের ঘরের স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। আবার দেখা যায় দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী সারা মাস কষ্ট করে যে টাকা বেতন পায় স্বামীরা তা মাদকসেবন, জুয়া খেলা, পরকীয়ার পেছনে ব্যয় করে। ফলে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হলে তা শেষে তালাকে গড়ায়।’

সমাজবিজ্ঞানী বললেন সমস্যার মূল কারণগুলো

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, একটা সময় গ্রামে বসবাসকারী ছেলেমেয়েরা গ্রামীণ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পারিবারিক শাসন, অভাব-অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠে। কিন্তু জীবনজীবিকার তাগিদে অল্প বয়সে ওরা যখন শহরে আসে, তখন চাকচিক্যময় নগরের কথিত বিনোদন, ফেসবুক, প্রসাধনী সবকিছুই যেন তাদের আকর্ষণ করে। পারিবারিক শাসন না থাকায় অবাধ স্বাধীনতার কারণে দিন দিন ওরা ভুল পথে পা বাড়ায়। গার্মেন্টসে চাকরির সুবাদে ছেলেমেয়েরা একে অন্যের সম্পর্কে কোন কিছু না জেনে না বুঝে অল্পদিনের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে প্রেমের সম্পর্কে। তাদের এই প্রেম কিছুদিনের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কে রূপ নেয়। ফলে বিয়ে না করেই ৪-৫ বছর ওরা এক সাথেই স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে সংসার করে। পরকীয়া, ইন্টারনেট, কথার অমিল, সন্দেহ আর বনিবনা না হওয়ার কারণে সন্তান রেখে অনেক পুরুষ লাপাত্তা, অনেক গার্মেন্টসকর্মীকে খুন হতে হয়েছে এই কথিত সম্পর্কের কারণে। তাছাড়া পারিবারিক কিংবা ধর্মীয়ভাবে তাদের বিয়ে না হওয়াতে সংসারগুলো ভেঙে যায় খুব সহজে।’

প্রফেসর ইফতেখার বলেন, ‘মোবাইলে সারাক্ষণ কথা বলা, ফেসবুক, ম্যাসেন্জার আসক্তির কারণে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ে জড়িয়ে পড়ছে কথিত পরকীয়ায়। আর এ পরকীয়া প্রেমের কারণে ডার্ক রেস্টুরেন্ট, পার্ক, আবাসিক হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয় ওরা। সংসার ভাঙার পিছনে এটাও একটা অন্যতম কারণ। সরকার, প্রশাসন, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও পরিবার সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং নারী-পুরুষের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!