চট্টগ্রামের বেপজা স্কুলে ৬১ ছাত্রের শিক্ষাজীবন নিয়ে অধ্যক্ষের হেলাফেলা, নেপথ্যে ‘কোচিং বাণিজ্য’

চট্টগ্রাম নগরীর বেপজা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষায় প্রায় ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী কাগজপত্রে ‘ফেল’ করেছে। কিন্তু ফেল করলেও এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের পরীক্ষার খাতা দেখতে দিচ্ছেন না প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ। ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর থেকে অভিভাবকরা ধরনা দিচ্ছেন অধ্যক্ষের কাছে। কিন্তু বারবার ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অনীহা দেখাচ্ছেন তিনি। একইসঙ্গে ফেল করা শিক্ষার্থীদের আবারও দশম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যক্ষ।

নগরীর ইপিজেড ও আশপাশের এলাকাগুলোর নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার জন্য সাধারণত স্কুলটি বেছে নেয়। সেখানে মাসে তাদের বেতন গুণতে হয় ১২৯০ টাকা। এর বাইরে ভর্তি ফিসহ আরও আনুষঙ্গিক খরচ তো আছেই। মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এমন সব খরচ মেটানো কঠিন হলেও এর মধ্যে এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীদের আবার দশম শ্রেণিতে পড়াশোনার যে পরামর্শ অধ্যক্ষ দিয়েছেন, সেটা অভিভাবকদের জন্য হয়ে ওঠেছে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’।

এদিকে এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষায় ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘ফেল’ করার পেছনে কোচিং বাণিজ্যকে দায়ী করছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। যেসব শিক্ষার্থী স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পড়াশোনা করেছে, শুধুমাত্র তাদেরই পাশ করানো হয়েছে— এমন অভিযোগ তুলেছেন তারা।

এসব শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ার পরই বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কাউছার আলী সরকারের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে দশম শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫৯ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ১৯৮ জন শিক্ষার্থী। বাকি ৬১ জন শিক্ষার্থী এক বা একাধিক বিষয়ে ফেল করেছে।

অভিভাবকসহ বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটিতে কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে অধ্যক্ষের যোগসাজশে চলছে নিয়মিত কোচিং বাণিজ্য। সঙ্গে চলছে আরও নানা অনিয়ম। এসব শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাস ও পরীক্ষায় রয়েছে ‘বিশেষ সুবিধা’। নির্বাচনী পরীক্ষায় যারা অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের অধিকাংশই এসব শিক্ষকের রোষানলের শিকার।

নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য একাধিক শিক্ষার্থী জানায়, তাদের অনেকেই ‘ভালো’ পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা শেষে বাসায় এসে তাদের অনেকে এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে দেখে, পাশ করেছে। কিন্তু স্কুলের রেজাল্টে ‘ফেল’ দেখানো হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে রেজাল্টও দেখানো হয়নি তাদের। তাদেরকে পরীক্ষার খাতাও দেখতে দেওয়া হয়নি।

একজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করে— ‘কারচুপির বিষয় রয়েছে বলেই হয়তো খাতা দেখায়নি। শুধুমাত্র মার্কশিট দেখিয়ে বলা হয়েছে, আমরা ফেল করেছি।’

শিক্ষার্থীরা জানায়, এভাবে তাদের নিয়ে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উদাসীন আচরণ করে, তাহলে তাদের শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হবে।

একাধিক শিক্ষার্থী ক্ষোভের সুরে জানায়, ‘এবারের এসএসসি পরীক্ষায় যদি আমরা অংশ নিতে না পারি, তাহলে বিভিন্ন কারণে অনেকের হয়তো আর পড়ালেখাও চালানো সম্ভব হবে না। এমনটা হলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার দায় কি প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়ে না?’

বেশ কয়েকজন অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটিতে ২০২৪ সালের এসএসসি নির্বাচনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পূজার বন্ধ চলাকালে গত ২৩ অক্টোবর হঠাৎ নোটিশ বোর্ডে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের তালিকা ঝুলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ফলাফল ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা নোটিশ বোর্ডে নিজেদের রোল নম্বর খুঁজে পেয়েছে, তারা উত্তীর্ণ হয়েছে বলে নিশ্চিত হতে পেরেছে। ২৫৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে রোল নম্বর খুঁজে পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯৮ জন।

অভিভাবকরা বলেন, গত ২৯ অক্টোবর আমরা অভিভাবকরা আবারও বিদ্যালয়ে গেলে প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ এ বিষয়ে কিছু বলছিলেন না। ২-৩ ঘণ্টা এভাবে কাটিয়ে দুপুর দেড়টার দিকে অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে ওনার অফিসের সামনে গেলে আমাদের ভেতর ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অধ্যক্ষ ‘ব্যস্ত আছেন’ জানিয়ে দেয় পিয়ন।

এভাবে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অধ্যক্ষ রুম থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের বলেন, তিনি এখন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। ৩টার পর আমাদের সঙ্গে বসবেন। এরপর আরও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা শেষে বিকাল ৪টার পর তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। তখন আমাদের সন্তানদের রোল নম্বর অনুযায়ী সিরিয়ালি একজন করে তার রুমে ডাকেন। আমাদের ডেকে কেবল মার্কশিট দেখিয়ে ফেল করার বিষয়টি জানান। আমরা পরীক্ষার খাতা দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। আমাদের বলা হয়, আমাদের সন্তান আরও এক বছর ১০ম শ্রেণিতে পড়ুক, পরের বছর এসএসসি দিলে ভালো করবে।

অভিভাবকরা ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, প্রতিমাসে আমরা ১২৯০ টাকা বেতন দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়িয়ে আসছি। এছাড়া নিয়মিত পড়ালেখা বাবদ আনুষঙ্গিক খরচ তো আছেই। এখন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের এমন আচরণের কারণে নির্দিষ্ট বছরে আমাদের সন্তান এসএসসি বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারলে আরও এক বছর পড়াতে হবে। আবারও প্রতিমাসে ১২৯০ টাকা বেতন দিয়ে পড়াশোনা করানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

অভিভাবকরা বলেন, একজন পরীক্ষার্থী জানে, সে কেমন পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার খাতা না দেখিয়ে কেবল মার্কশিট দেখিয়ে যদি সে শিক্ষার্থীকে বলা হয়, সে ফেল করেছে, তাহলে ওই শিক্ষার্থী কিভাবে মেনে নেবে? পাশ করুক বা ফেল করুক, তাকে তো তার খাতা দেখার সুযোগ দিতে হবে। একটা প্রতিষ্ঠান যদি একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমন স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করে এবং সেই শিক্ষার্থী যদি বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারে, তাহলে তো পড়ালেখা থেকেই তার মন উঠে যাবে। তার ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হবে৷

অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় বেপজা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) কাউছার আলী সরকারের সঙ্গে। তবে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র নাথ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা শিক্ষা বোর্ডে লিখিতভাবে অভিযোগ জানাতে পারে। তাহলে তা খতিয়ে বোর্ড ব্যবস্থা নিতে পারবে। কোনো শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল করলে বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না, এ ধরনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বোর্ডের নেই। বোর্ডের কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া আছে, সেসব নির্দেশনা মেনে চলবে প্রতিষ্ঠান।’

পরীক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষার খাতা না দেখানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা দেখানো যাবে না—এ ধরনের কোনো নির্দেশনা বোর্ডের নেই। পরীক্ষার্থীরা খাতা দেখতে পারবে।’

জেএন

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!