গার্মেন্টস চালুর নেপথ্যে মালিকদের অন্য মতলব!

গার্মেন্টস চালু রাখার নেপথ্যে সরকার থেকে প্রণোদনা আদায় করাই মালিকদের মূল লক্ষ্য। গার্মেন্টস মালিকরা ২ শতাংশ সাভিস চার্জে ঋণ চান না, চান অফেরতযোগ্য প্রণোদনা। এজন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পোশাক কারখানাগুলোর শ্রমিকদের। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও অনেক গার্মেন্টস শ্রমিককেই ‘রোববার বেতন দেওয়া হবে’ বলে প্রচারণা চালিয়ে গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও দূরদুরান্ত থেকে কারখানায় আসতে বাধ্য করছেন।

বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গার্মেন্টস মালিকরা সরকারের কাছে চেয়েছিল প্রণোদনা, কিন্তু তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে ঋণ। এই ঋণের টাকা গার্মেন্টস মালিকদের শোধ দিতে হবে ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না গার্মেন্টস মালিকরা। তাই সরকারের কাছ থেকে ফের প্রণোদনা নেওয়ার কৌশল হিসেবে সাধারণ ছুটির মধ্যেও গার্মেন্টস কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেশিরভাগ গার্মেন্টস মালিকই। গার্মেন্টস সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

এদিকে রোববার (৫ এপ্রিল) থেকে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার খবরে রাস্তাগুলোতে শ্রমিকদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন সড়কে হঠাৎ করে মানুষের ঢল দেখা গেছে। বিভিন্ন অঞ্চলের পোশাক কারখানার কর্মমুখী মানুষ পিকআপ, ট্রাক ও ভ্যানগাড়িতে করে কর্মস্থলে যোগ দিচ্ছেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অনেকে মহাসড়কে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে রওনা হয়েছেন।

যখন করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে, করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে যখন মানুষজনকে ঘরে রাখার জন্য সরকার সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে— এমন সময় রাস্তায় শ্রমিকদের ঢল দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

তবে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমএইর সভাপতি রুবানা হক বলছেন, ‘রাস্তার সব শ্রমিক গার্মেন্টস শ্রমিক নয়। যে কারণে গার্মেন্টস মালিকদের দায়ী করা ঠিক হবে না। কারণ ২৫ মার্চ গণপরিবহন বন্ধ হয়েছে। আর আমরা ২৬ মার্চের পর গার্মেন্টস বন্ধ করেছি। আর আমাদের অধিকাংশ শ্রমিক কারখানার আশেপাশে থাকে। কাজেই সংক্রমণ বাড়ানোর জন্য গার্মেন্টস খোলা হচ্ছে না। তিনি উল্লেখ করেন, করোনার সংক্রমণ ঠেকানো আমাদের প্রথম কথা। দ্বিতীয়ত শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন নিয়ে কোনও রকম অনীহার সুযোগ নেই। তৃতীয়ত, শ্রমিক যদি কোনও কারণে উপস্থিত না থাকেন, তাহলে মানবিক বিবেচনায় তার চাকরিটি যেন থাকে। বিজিএমইএর সব সদস্যের কাছে এই অনুরোধ আমি করবো।’

তিনি বলেন, কলকারখানা এবং পরিদর্শন অধিদফতর আমাদের যে সার্কুলার দিয়েছিলেন তাতে বলা আছে, যেসব রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানে অর্ডার আছে এবং উৎপাদন চলমান আছে, সেসব কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা একেবারে সুনিশ্চিতকরণ করে শিল্প কলকারখানা চালু রাখতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গার্মেন্টস মালিক বলেন, বেতন পেতে হলে শ্রমিককে আগামীকালকের (রোববার) মধ্যে অফিসে আসতে হবে— এমন নির্দেশনার পরই মূলত প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যাওয়া শ্রমিকরা দল বেঁধে চট্টগ্রাম আসছেন।

তিনি বলেন, কারখানা বন্ধ করার সময় ধারণা করা হয়েছিল, শ্রমিকরা কারখানার আশপাশে থাকবে। কিন্তু ১০ দিন ছুটি পেয়ে অধিকাংশই গ্রামে চলে গেছে। বিষয়টি সরকার জানে, গার্মেন্টস মালিকরাও জানে।

গার্মেন্টস মালিকদের বক্তব্য হল, এমনিতেই রফতানির বিপরীতে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা পেয়ে থাকেন। কেউ ৪ শতাংশ প্রণোদনা পান, কেউ ৬ শতাংশ প্রণোদনাও পেয়ে থাকেন।

একজন গার্মেন্টস মালিক বলেন, গার্মেন্টস মালিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে প্রণোদনা চাওয়া হয়েছিল। সরকার প্রথমে ঘোষণাও দিয়েছিলেন প্রণোদনার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার জারি করেছে, তাতে বলা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে আমরা ঋণ পাবো ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে। এটা প্রণোদনা নয়। কারণ ঋণের টাকা ফেরত দিতে হবে। এই দুর্যোগকালীন মুহূর্তে এই ধরনের ঋণ চাইছিলাম না। চাইছিলাম প্রণোদনা, যা ফেরত দিতে হবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ২ শতাংশ ইন্টারেস্ট দিয়ে ঋণ নিতে হবে।

তিনি বলেন, আগামীকাল প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গার্মেন্টস খাতের জন্য অফেরতযোগ্য একটি প্রণোদনা.ঘোষণা আশা করছেন এই খাতের নেতারা। যে প্রণোদনায় কোনও সার্ভিস চার্জ দিতে হবে না। এর আগে গত ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রাণঘাতী করোনার প্রতিঘাত মোকাবিলায় দেশের রফতানিমুখী খাতের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ ব্যাপারে বিজিএমইএ চট্টগ্রামের পরিচালক মোহাম্মাদ আতিক বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত ছিল ৪ এপ্রিল পর্যন্ত গার্মেন্টস বন্ধ থাকবে। সেটিই অনুসরণ করছেন মালিকরা। তবে সবাই খোলা রাখবে এমন কথা নয়, খুলবে ১০ থেকে ২০ শতাংশ কারখানা। যাদের জরুরি অর্ডার রয়েছে।

এদিকে করোনাভাইরাসে কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সদস্যভুক্ত সব নিট পোশাক কারখানা আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শনিবার (৪ এপ্রিল) রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠনের সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!