কাভার্ড ভ্যানে গ্যাস সিলিন্ডারের ‘বোমা’, চট্টগ্রামের গাড়িই গাজীপুরে গিয়ে বিস্ফোরিত

মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে সরবরাহ হয় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে

চট্টগ্রামের সংঘবদ্ধ একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে কাভার্ড ভ্যানের ভেতর গ্যাসের মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারে ফিলিং স্টেশনের গ্যাস ভর্তি করে সারাদেশে গার্মেন্টসের বয়লার ফ্যাক্টরিতে সরবরাহ করছে। এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা বলছেন, কার্ভার্ড ভ্যানে এ হল রীতিমতো চলন্ত বোমা!

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে চট্টগ্রামে কাভার্ড ভ্যানে করে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারে গ্যাসবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত গ্যারেজ-দোকান ছাড়াও পাওয়া গেছে মূল হোতাদের খোঁজও।

কাভার্ড ভ্যানে গ্যাস সিলিন্ডারের ‘বোমা’, চট্টগ্রামের গাড়িই গাজীপুরে গিয়ে বিস্ফোরিত 1

১৩ অক্টোবর গাজীপুর মহানগরের বড়বাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকার সিএনজি স্টেশনে কাভার্ডভ্যানের ভেতর রাখা সিলিন্ডারে অবৈধভাবে গ্যাস সরবরাহ করার সময় বিস্ফোরণে পাঁচজন দগ্ধ হন। এদের মধ্যে মিঠু (২৬) নামের একজনের শরীর প্রায় শতভাগ দগ্ধ হয়ে পরে মারা যান। বাকি চারজনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাদেরকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় সিলিন্ডারবোঝাই একটি কাভার্ডভ্যান বড়বাড়ি হাজী ওয়াহেদ সরকার সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস নিতে আসে।

কাভার্ড ভ্যানে গ্যাস সিলিন্ডারের ‘বোমা’, চট্টগ্রামের গাড়িই গাজীপুরে গিয়ে বিস্ফোরিত 2

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকেই বিশেষ উপায়ে তৈরি সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানে গ্যাস ঢোকানো হচ্ছিল গাজীপুরের সেই ফিলিং স্টেশন থেকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কাভার্ডভ্যানের ভেতর থাকা সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহের সময় স্পার্ক করে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে মুহূর্তের মধ্যে সিএনজি স্টেশনে আগুন লেগে যায়। ভয়াবহ বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন সিএনজি স্টেশন থেকে মহাসড়কের পাশে ছিটকে পড়েন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং এলাকার ১২ কোয়ার্টার আলীর গ্যারেজে ১০২টি সিলিন্ডার কেটে বিশেষ উপায়ে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় একটি কাভার্ড ভ্যানের ভেতরে। ওই ভ্যানটির নম্বর চট্টমেট্রো ট-১১-২২৫৭। এরপর ১৩ অক্টোবর ওই গাড়িটিই গাজীপুরে পৌঁছে সেখানকার সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার সময় প্রাণঘাতী বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেই গ্যাস সেখানকার একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির বয়লারে সরবরাহ করার কথা ছিল।

এর আগে ঘটনাচক্রে নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্য পাওয়ার পর ৩০ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেদক আলীর গ্যারেজে উপস্থিত হয়ে ওই কাভার্ড ভ্যানটিতে (চট্টমেট্রো ট-১১-২২৫৭) গ্যাস সিলিন্ডার স্থাপন করতে দেখেন। প্রতিবেদকের উপস্থিতি টের পেয়ে পরে গ্যারেজমালিক আলী গাড়িটি সরিয়ে ফেলেন। এরপর প্রতিবেদক নগরীর ডবলমুরিং থানার ওসিকে ফোনে না পেয়ে পাহাড়তলী থানার ওসিকে ফোনে এ বিষয়ে অবহিত করেন। তবে সেই ওসি জানান, বিষয়টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের এখতিয়ারে। তাছাড়া ঘটনাস্থল তার এলাকায়ও পড়ে না।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া ওই কাভার্ড ভ্যান সরবরাহ করেন আকবরশাহ এলাকার বাসিন্দা আলমগীর নামের এক ব্যক্তি। গাজীপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পরপরই এই আলমগীর তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেন বলেও চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে। তার সঙ্গে সমন্বয়কারী হিসেবে রয়েছেন পাহাড়তলী থানা এলাকার বাসিন্দা চৌধুরী ও সেলিম। অন্যদিকে কাভার্ড ভ্যানে গ্যাস সিলিন্ডার স্থাপনের কাজটি করেন আলীর গ্যারেজের আলী ও আনোয়ার মিস্ত্রি।

এদিকে রোববার (১৬ অক্টোবর) গাজীপুরের গাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইব্রাহীম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি জানান, বিপজ্জনক গ্যাস সিলিন্ডারবাহী কাভার্ডভ্যানটি বিস্ফোরিত হওয়ার পর তারা গাড়ির মালিক বা কোন কিছু শনাক্ত করতে পারেননি।

এরপর তাকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর তোলা কাভার্ডভ্যানের নম্বরের ছবি পাঠানো হলে গাছা থানার ওসি সেটা সঠিক বলে জানান এই প্রতিবেদককে।

জানা গেছে, বিভিন্ন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির বয়লারে (পানি গরম করা) খরচ কমাতে তেলের বদলে গ্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এজন্য চুক্তিভিত্তিতে বাইরে থেকে অথবা নিজস্ব গাড়ির ভেতরে গ্যাস সিলিন্ডার বসিয়ে গ্যাসের চাহিদা পূরণ করেন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিকরা। বাইরে থেকে গাড়ি আনলে সেই গাড়ির মালিককে মাসিক ভিত্তিতে দেওয়া হয় মোটা অংকের টাকা।

এদিকে রোববার (১৬ অক্টোবর) চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিংয়ে আলীর গ্যারেজে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা মেট্রো ট-১৪-২৪১১ নম্বরের আরও একটি কাভার্ড ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। গ্যারেজ সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি জানান, গ্যাস সিলিন্ডার বসানোর জন্যই ওই কাভার্ড ভ্যানটি গ্যারেজে আনা হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য গ্যারেজ মালিক আলীর খোঁজ করা হলে মিস্ত্রি আনোয়ার (৪৫) জানান, তিনি (আলী) একটু আগে বের হয়ে গেছেন। তার ফোন নম্বর দিতেও তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!