চট্টগ্রামে ৪০ বছরের পুরনো গ্যাসলাইন হয়ে উঠেছে ‘টাইম বম্ব’, লিকেজ খুঁজতে লঙ্কাকাণ্ড

চট্টগ্রাম নগরীর বাসাবাড়ি, অফিস, দোকান, রেস্টুরেন্ট— যেখানেই গ্যাসের লাইন রয়েছে, সে লাইনের প্রতিটার সাথেই জড়িয়ে রয়েছে ঝুঁকি ও মৃত্যুফাঁদ। কারণ এসব গ্যাসলাইনের বেশিরভাগই ৪০ বছরের পুরনো। স্থাপিত লাইনের অর্ধেকের মেয়াদ পেরিয়েছে অনেক আগেই। ফলে ছোট-বড় গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে প্রায়ই ঘটছে বিস্ফোরণের ঘটনা। আর গ্যাসলাইনগুলো হয়ে উঠেছে রীতিমতো ‘টাইম বম্ব’।

পাথরঘাটা থেকে এবার উত্তর কাট্টলী। এবারও সেই নভেম্বরেই ঘটলো একইরকম মর্মন্তুদ ঘটনা। সোমবার (১ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১২টায় উত্তর কাট্টলীর মরিয়ম ভিলার ছয়তলার ফ্ল্যাটে কেউ একজন মশা মারার ব্যাটটি চালু করতেই স্পার্ক থেকে ঘরে জমে থাকা গ্যাস জ্বলে ওঠে দপ করে। মুহূর্তেই ছড়িয়ে যাওয়া আগুনে মারাত্মকভাবে পুড়ে যান ৯ বছরের এক শিশুসহ ওই পরিবারের ছয় সদস্য। দগ্ধ ছয়জনকে রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তবে মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় মারা গেছেন ওই বাড়ির গৃহকর্ত্রী সাজেদা বেগম (৪৯)।

গত বছরের ৮ নভেম্বর এই একই বিল্ডিংয়ের একই ফ্ল্যাটে গ্যাসের লাইনের লিকেজ থেকে জ্বলে ওঠা আগুনে অন্য একটি পরিবারের ৯ জন দগ্ধ হন। এদের মধ্যে একজন মারা যান। তবু বাড়িওয়ালা গ্যাসের লাইন মেরামত করেননি।

এর আগে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের পাথরঘাটা ব্রিক ফিল্ড রোডের পাঁচতলা বড়ুয়া ভবনের নিচতলায় গ্যাসের পাইপলাইনে বিস্ফোরণের পর ভবনের একাংশের দেয়াল ধসে পড়ে। এ ঘটনায় ৭ জন নিহত হন। আহত হন আরও ১০ জন। পরে সেই ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। ওই ঘটনায় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) এর বিরুদ্ধে গাফিলতির জোরালো অভিযোগ ওঠে।

এই দুটি ঘটনারই মূল কারণ জরাজীর্ণ গ্যাসলাইনের লিকেজ। এই লিকেজ থেকে আগুন লেগে কেবলমাত্র তিনটি ঘটনাতেই মারা গেলেন নয়জন।

উত্তর কাট্টলীতে আগুনে পোড়া পরিবারটির গৃহকর্তা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী জামাল শেখ বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই আমি যখন রাতে ডিউটি শেষ করে বাসায় আসি তখন আমার পরিবারের সদস্যদের একটাই অভিযোগ— আব্বা গ্যাসের গন্ধ আসে। আমি বিষয়টি ভবন মালিককে জানাই। কিন্তু তারা কিছু হবে না বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, আমার ছেলেরাও ভবন মালিককে বেশ কয়েকবার এ বিষয়ে অবহিত করে। কিন্তু আগের মতো জবাব দেন ভবনমালিক। একটু ব্যবস্থা নিলে আমার পরিবার বেঁচে যেত।’

জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীতে বর্তমানে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৫টি আবাসিক বার্নার রয়েছে। এজন্য ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার সরবরাহ লাইন ব্যবহার করা হয়েছে। গ্যাস সরবরাহ, সংযোগ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য রাইজার রয়েছে দেড় লাখ। তবে ১৯৮৪ সাল থেকে গ্যাস সরবরাহ করে আসা সাবেক তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড বর্তমানে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের গ্যাসলাইন এবং রাইজারগুলো পুরনো। ফলে এগুলো হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় সময়ে ছোট-বড় গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। মাঝেমধ্যে মূল লাইন পরীক্ষা করা হলেও বাসাবাড়ির সংযোগ লাইন পরীক্ষা করা হয় না।

দিনের পর দিন অনেকটা বিপজ্জনকভাবেই চলছে চট্টগ্রাম নগরীর গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থা। তা নিয়ে অবশ্য সংশ্লিষ্টদের খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ‘সুপারিশ’ করা হয়। কয়েকদিন তোড়জোড় থাকে। পরবর্তীতে সব আগের অবস্থাতেই ফিরে যায়।

২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কার্বন ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট (সিডিএম) প্রকল্পের আওতায় প্রথমবারের মত চট্টগ্রাম নগরীর এক লাখ ৫ হাজার রাইজার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ২৮ টিমে উত্তর ও দক্ষিণ জোনে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। ওই পরীক্ষায় মোট দেড় লাখের মধ্যে এক লাখ ৫ হাজার রাইজার পরীক্ষায় শতকরা ৮ ভাগ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেই হিসাবে মোট ৮ হাজার ৪০০ রাইজার ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে সেই সময়েই মেরামত করা হয়েছিল ওই প্রকল্পের আওতায়।

এদিকে গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন না ঘটলেও চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন বাসা-বাড়ির গ্যাসের লাইনে লিকেজ খুঁজে বের করতে ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নিয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। ‘মোবাইল গ্যাস লিকেজ ডিটেক্টর’ নামে প্রকল্পটির জন্য ২০২০ সালের শেষে টেন্ডার হলেও কাজ শুরু হয়েছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। তবে এরই মধ্যে এ পাইলট প্রকল্পটির সক্ষমতা আর কার্যকারিতা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

জানা গেছে, ‘মোবাইল গ্যাস লিকেজ ডিটেক্টর’ নামের এই প্রকল্পে একটি মেশিনের সাহায্যে গ্যাস লাইনের লিকেজ খোঁজার কাজ করা হয়। সিঙ্গাপুরভিত্তিক জিকম ইকুয়েপমেন্ট লিমিটেড কোম্পানি এই মেশিন সরবরাহ করেছে। প্রকল্প গ্রহণের সময় বলা হয়েছিল, বিশেষায়িত একটি গাড়িতে স্থাপিত ওই মেশিন দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের সব গ্যাস লাইনের লিকেজ অনুসন্ধান করা হবে। একই সাথে রাইজার পরীক্ষাও সম্পন্ন করা হবে।

বিশেষায়িত সেই গাড়িটি একটি রাস্তা দিয়ে চলার সময় দুই পাশের অন্তত ৬০ ফুটের মধ্যে গ্যাস লাইনের যত লিকেজ আছে সব চিহ্নিত করবে। সবগুলো লিকেজের তথ্য গাড়িতে রাখা কম্পিউটার মনিটরে ধরা পড়বে। তখন গ্রাহককে লিকেজ মেরামত করার জন্য সতর্ক করে আসবেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রামে স্থাপন করা গ্যাসলাইন রাইজারগুলো দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হওয়ায় বহু লাইনে মরিচা এসেছে। লিকেজ এসেছে। পুরাতন রাইজারের রেগুলেটর এবং ভাল্ব নষ্ট হয়েছে। কিন্তু একটি একটি করে রাইজার পরীক্ষা করা, লিকেজ উদ্ধার এবং মেরামত করা কঠিন কাজ। আবার লাইনের লিকেজ চিহ্নিত করাও কঠিন। তাই এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল।

তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। মূলত মেশিনটি কাজ করবে রাস্তার পাশের ভবনে। তাছাড়াও সবচেয়ে যে বড় গলদ তা হলো, গ্যাস লাইনের লিকেজ চিহ্নিত করে গ্রাহককে তা মেরামতের নির্দেশ দিয়ে আসছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু গ্রাহক তা মেরামত করছেন কি-না সে ব্যাপারে কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষের কোনো তদারকি নেই। ফলে লিকেজ চিহ্নিত করলেও তার সমাধান মিলছে না। তাই ঢাকঢোল পিটিয়ে গাড়ি-যন্ত্রপাতি নিয়ে লিকেজ খুঁজে বের করাটাকে কেবল তামাশা হিসেবেই দেখছেন নগরবাসী।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীতে গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া গ্যাসলাইনের লিকেজ চিহ্নিত করা হয়েছে ৫২৫টি। এর মধ্যে গ্রাহক মেরামত করেছেন ১২৫টি লিকেজ। এ হিসেব গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত।

জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীতে মোট ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাইপলাইন থাকলেও ‘মোবাইল গ্যাস লিকেজ ডিটেক্টর’ প্রকল্পের আওতায় সার্ভে করা হবে মাত্র ৮৪০ কিলোমিটার। মোবাইল ডিটেক্টর গাড়িটি মূলত খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, চাক্তাই, বায়েজিদ, ইপিজেডসহ শিল্পপ্রধান এলাকাগুলোর গ্যাস লিকেজ চিহ্নিত করবে বলে জানা গেছে।

সচেতন নাগরিকরাই শুধু নন, কর্ণফুলী গ্যাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনেকেও গ্যাসলাইনের লিকেজ খোঁজার এই প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অভিজ্ঞতা থেকে এমন কয়েকজন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছেন, চট্টগ্রাম নগরীতে ঘনবসতিপূর্ণ এমন সব এলাকা রয়েছে যেখানে গাড়ি ঢোকা তো দূরে থাক, দুজন মানুষও একসাথে ঢুকতে পারে না।

ওই কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, মূলত চট্টগ্রামের এসব ঘিঞ্জি এলাকার বাসাবাড়িতেই গ্যাস লাইন ও রাইজার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাই গ্যাসলাইনের লিকেজ খোঁজা প্রকল্পের গাড়ি যদি এসব এলাকায় না যেতে পারে, তবে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই মুখ থুবড়ে পড়বে।

এ প্রসঙ্গে কেজিডিসিএলের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) সারোয়ার জাহানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি চলমান। তবে করোনার জন্য কাজে কিছু ব্যাঘাত ঘটেছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!