দুর্নীতির আখড়া রাঙ্গামাটির বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ

দুর্নীতির আখড়া রাঙ্গামাটির বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ 1চৌধুরী হারুনুর রশীদ, রাঙ্গামাটি : ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে রাঙ্গামাটি বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ। এসব অনিয়ম দুর্নীতির শীর্ষে এ রাঙ্গামাটির বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ কান্তি মজুমদার। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (অনুসন্ধান ও তদন্ত-২) মো. মঞ্জুর মোর্শেদের ১৯ অক্টোবর স্বাক্ষরিত (স্মারক নম্বর-দুদক/১৩১-২০১৭/অনু: ও তদন্ত-২/রাঙ্গামাটি/৩১৯) এক চিঠিতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালককে রাঙ্গামাটি বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ কান্তি মজুমদারের বিরুদ্ধে সরকারের ৩৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অভিযোগটি প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছে দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান কার্যালয় হতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের রাঙ্গামাটির বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ কান্তি মজুমদারের বিরুদ্ধে ৩৩ কেভি বিদ্যুৎ লাইন সংস্কারের নামে সরকারের ৩৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগটি অনুসন্ধানের নিমিত্ত একজন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ও একজন তদারককারী কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য কমিশনে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ অবস্থায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭ অনুসরণে অভিযোগটি তদন্ত করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সবুজ কান্তি মজুমদার প্রকৌশলী বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ রাঙ্গামাটি যত প্রকার ফাঁক-ফোকর আছে ফাঁকি দিয়ে লুটপাট করছেন সরকারি অর্থ। পাশাপাশি হাতিয়ে নিচ্ছেন গ্রাহকদের থেকে ঘুষ ও কমিশন। সব টেন্ডারের কাজ করাচ্ছেন পকেটের এক ঠিকাদার দিয়ে। বিনিময়ে ওই ঠিকাদার হতে পাচ্ছেন লভ্যাংশের পর্যাপ্ত সুবিধা। তার কাছে জিম্মি সাধারণ কর্মচারীরাও। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে বৈদ্যুতিক লাইনের নামে ৩৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তে নির্দেশ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে রাঙ্গামাটির সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, অভিযোগটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে পরিচালককে। তাই তদন্তের অগ্রগতি কতটুকু এ মুহূর্তে সঠিক বলা যাচ্ছে না। আমাদের কাছে চিঠি পাঠানো হলে বিস্তারিত জানা যাবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কাজ না করে বিদ্যুৎ লাইন সংস্কারের নামে সরকারের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে রাঙ্গামাটি বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগে। ঘুর্ণিঝড় মোরা এবং ১৩ জুনের রাঙ্গামাটির পাহাড় ধসের ঘটনায় বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুতের খুঁটি, ট্রান্সফরমার পুন:স্থাপন এবং লাইন সংস্কারের কাজে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৪৫-৪৭ শতাংশ সিস্টেম লজ দেখিয়ে তা কাটিয়ে ওঠার নামে গ্রহকদের অতিরিক্ত ২০০-৩০০ ইউনিট বিল দেয়া হচ্ছে। গ্রাহকদের মিটার না দেখে অতিরিক্ত হারে গড়বিল দিতে নির্দেশ দেয়া হয় মিটার পাঠাকদের। এসব নির্দেশ দেন নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ কান্তি মজুমদার- যা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন, সংশ্লিষ্ট মিটার পাঠকরা।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন গ্রাহক অনেকে। তাদের দেয়া তথ্যমতে, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল দেয়ার এক পর্যায়ে যখন মোটা অংকে গিয়ে দাঁড়ায় তখন তা যাচাইয়ে গ্রাহকরা অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করতে বাধ্য হন। এ সময় আপসে গ্রাহকদরে কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে বিদ্যমান মিটার অকেজো করে নতুন মিটার বসিয়ে দিয়ে কম পরিমাণ ইউনিটে নতুন করে বিল ইস্যু করানো হয়। এ কাজটি করেন সরাসরি নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ কান্তি মজুমদার। এভাবে চরম হয়রানি করা হচ্ছে গ্রাহকদের।
অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল প্রদানে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, খোদ সরকারি এক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছাদেক আহমদ। তিনি বলেন, তিনি ঘরে থাকেন একা। তা ছাড়া বেশিরভাগ সময় কাটে অফিসে। কিন্তু তাকে মাসিক বিদ্যুৎ বিল দেয়া হয় ৬০০০-৭০০০ টাকা। যে বাসায় তিনি থাকেন সেখানে মিটার আছে। অথচ কোনো মাসেই মিটার দেখতে যান না বিদ্যুৎ বিভাগের মিটার পাঠকরা। তিনি ছাড়াও এমন অভিযোগ করেছেন, অমর চাকমা, বাবুল চক্রবর্তীসহ শহরের অনেক গ্রাহক।
রাঙ্গামাটি বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের এক তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদ্যুৎ পরিচালন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে পাওয়া ৮৩ লাখ টাকার বরাদ্দের ব্যয় হয়েছে ৮১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এসব কাজে দেয়া হয় ১৫ কার্যাদেশ। পূর্ত মেরামত কাজে পাওয়া ১৫ লাখ টাকার বরাদ্দের ব্যয় হয়েছে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এতে দেয়া হয় ৬ কার্যাদেশ। যানবাহন মেরামত কাজে পাওয়া ১১ লাখ টাকার বরাদ্দের ৫ কার্যাদেশে ব্যয় হয়েছে ১০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা এবং আসবাবপত্র মেরামত কাজে পাওয়া ৫০ হাজার টাকার বরাদ্দের মধ্যে ২৩ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে দরপত্র আহবান করা হয় ৩০টি। কিন্তু এসব কাজে সিংহভাগ অর্থ লুটপাট করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। অনেকগুলো কাজে কাগজে বাস্তবায়ন দেখিয়ে সম্পূর্ণ টাকা ভুযা ভাউচারে আত্মসাৎ করা হয় বলে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
তথ্যমতে, রাঙ্গামাটি শহরে বর্তমানে ট্রান্সফরমার রয়েছে ১৪৫টি। সেগুলো প্রতি বছর রুটিন, পিরিয়াডিক ও গ্রাহক অভিযোগের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক রক্ষণাবেক্ষণ করার নামে এবং কোনো এলাকার ট্রান্সফরমার বিকল হলে বিউবোর আঞ্চলিক মেরামত কারখানার মাধ্যমে মেরামত করে প্রতিস্থাপনের নামে কাজ না করে ভুয়া বিল ও ভাউচার দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয় লাখ লাখ টাকা। ঘুণিঝড় মোরা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত লাইন সংস্কার ও ট্রান্সফরমার পুন:স্থাপনের জন্য সাড়ে চার কোটি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ৩ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। সেগুলো চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন কাজের নামে আত্মসাতের পায়তারা চলছে। এসব অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত রাঙ্গামাটির বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ কান্তি মজুমদারসহ কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
দানবীর চাকমাসহ কয়েকজন ঠিকাদারের তথ্যমতে, নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ কান্তি মজুমদার যোগদানের পর থেকে রাঙ্গামাটি বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের যত টেন্ডারের কাজ সববগুলো দেয়া হচ্ছে ‘মেসার্স কাজী ইঞ্জিনিয়ার্স’ নামে প্রতিষ্ঠানকে। এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক কাজী নিজাম উদ্দিন জামায়াতপন্থী। সাধারণ ঠিকাদাররা এখন কোনো কাজই পাচ্ছেন না। সবুজ কান্তি মজুমদার টেন্ডারগুলো গোপন রেখে কার্যাদেশ দেন মেসার্স কাজী ইঞ্জিনিয়ার্সকে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেসার্স কাজী ইঞ্জিনিয়ার্স’এর ঠিকানা ব্যবহার করা হয় ভিন্ন ভিন্ন স্থান। এর প্যাডে ঠিকানা উল্লেখ করা হয় কখনও চট্টগ্রামের ধনিরামপাড়া, কখনও রাঙ্গামাটির রাঙ্গাপানি আর ভেদভেদীর মুসলিমপাড়া। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্ত্বাধিকারী কাজী নিজাম উদ্দিনের জাতীয় পরিচয়পত্র, ঠিকাদারি লাইসেন্স ও প্যাডে উল্লেখ করা ঠিকানার কোনটির সঙ্গে কোনটি-ই মিল নেই। তার ঠিকাদারি লাইসেন্সের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তবে নবায়নের জন্য আবেদন করা হয়েছে মর্মে দাবি করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট একজন।
এদিকে ৩৩ কেভির ৮টি টাওয়ারসহ অন্য মালামাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান, রাঙ্গামাটি বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের কর্মচারীরা। তারা বলেন, এসব মালামালের মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কোনো ঠিকাদারের যোগসাজশে সেগুলো বিক্রি করে পাচার করা হয়েছে।
অভিযোগ সম্পর্কে মতামত জানতে যোগাযোগ করা হলে রাঙ্গামাটি বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ কান্তি মজুমদার বলেন, তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। তিনি শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছেন। কোনো রকম অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত নন। তার বিরুদ্ধে দুদকে কী অভিযোগ হয়েছে, কে করেছে তা নিয়ে কিছুই জানা নেই। মেসার্স কাজী ইঞ্জিনিয়ার্স নামে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!