‘সুপারফাইভ’ ঘরানায় ৩ বছর পার চট্টগ্রাম নগর বিএনপির থানা কমিটি

দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চট্টগ্রাম নগর বিএনপির কমিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৬ আগস্ট। কিন্তু এই তিন বছরে আকবরশাহ থানা ছাড়া নগরীর অন্য কোনো সাংগঠনিক থানার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি শাহাদাত-বক্করের নেতৃত্বে থাকা নগর কমিটি।

থানা কমিটিগুলো চলছে ‘সুপারফাইভ’ ঘরানায়। আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, অর্থ সচিব, সদস্য—এই পাঁচটি পদে নেতার নাম ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে নগর কমিটি। আহ্বায়ক কমিটিকে নির্দেশনা দিয়েছিল সেই এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে নগর কমিটি থেকে অনুমোদন নিতে। কিন্তু কোনো কোনো থানা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করছে বললেও কোনো থানাই তা নগর কমিটির কাছে জমা দেয়নি। আবার খুলশী থানা কমিটিতে হাতও দিতে পারেনি নগর কমিটি। কারণ ওই কমিটির আহবায়ক অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার, যিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের ঘনিষ্ঠজন।

ওয়ার্ড কমিটিগুলোও চলছে থানা কমিটির মতো। জালালাবাদ, পাঁচলাইশ, বকসিরহাট, কাট্টলীসহ কয়েকটি ওয়ার্ডে আহবায়ক আর সদস্য সচিবের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। জামালখান, বাগমনিরাম, উত্তর আগ্রাবাদ, মাদারবাড়ি, উত্তর মাধ্যম হালিশহর, পাথরঘাটাসহ কয়েকটিতে পাঁচ সদস্যের আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো আহবায়ক কমিটিতে ১০ থেকে ২০জন সদস্য রাখা হয়েছে। চকবাজার, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, মোহরাসহ কয়েকটি ওয়ার্ডে পূর্ণাঙ্গ কমিট ঘোষণা করা হয়েছে, তবে তা সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ।

বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও চাকসুর এজিএস মাহবুবের রহমান শামীম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সময় গণনা শুরু তিন সদস্যের কমিটি ঘোষণা থেকেই। কেন্দ্রীয় এই নেতার কথাতে পরিষ্কার—নগর বিএনপির কমিটি গঠনতান্ত্রিকভাবে মেয়াদ উত্তীর্ণ হচ্ছে আগামী ৬ আগস্ট।’

সভাপতি মনোনীত হওয়ার পর ডা. শাহাদাত হোসেনও নাসিমন ভবনের একটি অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়েছিলেন মেয়াদ শেষে তিনি নতুনদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেবেন। তবে মেয়াদের শেষ সময়ে এসে তার মনোভাব জানতে একাধিকবার তার মুঠোফোনে ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ডবলমুুরিং ও আকবরশাহ থানা কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কোতোয়ালী থানা কমিটি গঠন করা হয়েছে, কিন্তু ঘোষণা করা হয়নি। তবে অন্যান্য থানাগুলোতে ‘সুপারফাইভ’-এর আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। ওয়ার্ড কমিটি গঠন নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, কিছু ওয়ার্ডে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিছু কমিটি গঠন হয়েছে, ঘোষণা হয়নি। আর কিছু এখনও আহবায়ক কমিটি দিয়ে চলছে, সম্মেলনের মাধ্যমে অবশিষ্ট ওয়ার্ড কমিটিও গঠন করা হবে।

২০১৬ সালের ৬ আগস্ট কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে তিন সদস্যের চট্টগ্রাম নগর কমিটি ঘোষণা করেছিল দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্র থেকে সময় দেওয়া হয়েছিল এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি চূড়ান্ত করে কেন্দ্রে জমা দিতে। এক মাসের পরিবর্তে এগারো মাস সময় নিয়েছিলেন পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে। গঠনতন্ত্রে নগর কমিটির আকার ১৫১ সদস্যের উল্লেখ থাকলেও এরস্থলে ২৭৫ সদস্যের ঢাউস কমিটি ঘোষণা করেছিল। সেই কমিটির সবাইকে নিয়ে গত দুই বছরে একবারও একসঙ্গে বসতে পারেনি নগর বিএনপি।

নির্দিষ্ট মেয়াদে কমিটি করার নজির বিএনপি এর আগে কখনও দেখাতে পারেনি। ২০১০ সালে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে সভাপতি ও ডা. শাহাদাত হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে তা কেন্দ্রে জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই কমিটি সাড়ে ছয় বছরেও পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। উপরন্তু ২০১১ সালে দস্তগীর চৌধুরী মারা যাওয়ার পর বাকি সময়টা অবশিষ্ট চার জনের কমিটিই ছিল। সেই সুপার ফাইভের পর শাহাদাত-সুফিয়ান-বকরকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখে বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশেই বিএনপি একই ফলাফল অর্জন করেছে। কিন্তু নির্বাচনী মাঠেও বিএনপির অবস্থান জোরালো ছিল না।

এর আগে ২০০৮ সালে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৪ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই ১৪ জন কখনো এক সাথে বসতেও পারেনি।

তারও আগে ২০০৫ সালে সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমকে আহবায়ক করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর তিন সদস্য ছিলেন সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, এম মোরশেদ খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এ চারজন এক কিংবা একমত হতে পারেননি ২০০৮ সাল পর্যন্ত। ২০০৯ সালের শেষ দিকে সম্মেলন আয়োজন করেও বিশৃংখলার জন্য কমিটি করতে পারেনি নগর বিএনপি। ব্যাপক মারামারির ঘটনা ঘটেছিল সেদিন ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন চত্বরে। এর আগে মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন-দস্তগীর চৌধুরীর কমিটি ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ছিল। তবে এখনও পর্যন্ত কেবল সেই কমিটিই ওয়ার্ড ও থানা কমিটি দিতে পেরেছিল।

বিএনপি গঠিত হওয়ার পর মাত্র একবার সম্মেলন করে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কমিটি গঠিত হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে নগরীর মুসলিম হলে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মরহুম কেএম ওবায়দুর রহমানের উপস্থিতিতে ওই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে সভাপতি নির্বাচিত হন আবদুল্লাহ আল নোমান ও সাধারণ সম্পাদক হন একরামুল করিম। ওয়ান- ইলেভেনের পর একরামুল করিম কর্নেল (অব.) অলি আহমদের হাত ধরে এলডিপিতে যোগ দিয়ে নগর কমিটির সভাপতি হন।

১৯৮১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিজের পছন্দমতো কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন এম সলিমউল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম।
১৯৮৪, ৯৪, ৯৬ ও ৯৭ সালে নগর বিএনপির কমিটি গঠিত হলেও এর কোনোটি সম্মেলনের মাধ্যমে হয়নি। কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেইসব কমিটি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!