বিখ্যাত বেকারী পন্যের নামে আমরা কি খাচ্ছি! নোংরা কালো পুরাতন তেলে ভাজা হয় কিষোয়ানের পণ্য! অব্যাহত অভিযানেও থামছেনা খাদ্যে বিষ মেশানো

রাজীব সেন প্রিন্স :

বিখ্যাত বেকারী পন্যের নামে আমরা কি খাচ্ছি! একবারও কি কখনো ভেবে দেখেছি এতো নামিদামী খাদ্যপণ্য তৈরি ও বাজারজাত করণ প্রতিষ্ঠানের সুস্বাধু খাদ্যের পরিবর্তে আমরা আসলেই কি খাচ্ছি। ফ্রেশ পণ্যের নামে আমরা দেহের ভেতর জন্ম দিচ্ছি নানান রকম রোগব্যাধি। র‌্যাব ও জেলা প্রশাসনের অব্যাহত অভিযানেও থামছে না খাদ্যে ভেজাল ও বিষ মেশানোর প্রক্রিয়া। কিছু অসাধু কর্মকর্তার মাসোহারায় এমন অপরাধ করে যাচ্ছে বেকারী মালিকরা।

বিখ্যাত বেকারী পন্যের নামে আমরা কি খাচ্ছি! নোংরা কালো পুরাতন তেলে ভাজা হয় কিষোয়ানের পণ্য! অব্যাহত অভিযানেও থামছেনা খাদ্যে বিষ মেশানো 1

জানা যায়, অভিজাত নামী-দামি বেকারীতে বিক্রি হচ্ছে বিস্কুট, চানাচুর, কেক,পাউরুটি, মিষ্টি সহ নানা বাহারী মুখরোচক খাবার। কখনো কি কেউ ভেবে দেখেছেন এই খাবারগুলো কোথা থেকে আসছে? কোথায় তৈরী হচ্ছে? কি দিয়ে তৈরী হচ্ছে এসব খাবার? এসব খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রন ও যাচাই করার দায়িত্বে যারা আছেন তারা কি তাদের দায়িত্ব পালন করছেন?

 

নামি দামি বেকারিতে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা পরিবেশে ভেজাল ও নিম্নমানের উপকরন দিয়ে অবাধে তৈরী করা হচ্ছে বেকারী সামগ্রী। এসব বেকারী গুলোতে তৈরী হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে নানান ধরনের বেকারী খাদ্য। কারখানার ভেতরে যেখানে তৈরী খাবার রাখা আছে সেখানেই রয়েছে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, কেমিক্যাল এবং একাধিক পাম ওয়েলের ড্রাম ও আটা, ময়দার গোডাউন।

 

এখানকার শ্রমিকরা খালি গায়ে কোন রকমের হাত গ্লোবস ব্যবহার না করেই খালী হাতে ময়দার খামী থেকে বিস্কুট তৈরী করছে। গামছা পরিহিত ঘর্মাক্ত অবস্থায় খালি পায়ে এসব পণ্যের পাশ দিয়ে হরদম করে হাটাচলা। উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ন তারিখ ছাড়াই বাহারি মোড়কে বনরুটি, পাউরুটি, কেক, বিস্কুট,পুডিংসহ বিভিন্ন ধরনের বেকারী সামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে দেদারছে। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যাদের বাহারি নামের চোঁখ ধাঁধানো মোড়ক থাকলেও নেই কোন বিএসটিআই বা সংশ্লিষ্ট কোন লাইসেন্স। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোড়কের গায়ে উৎপাদনের তারিখ লেখা থাকলেও কত তারিখে মেয়াদোত্তীর্ন হবে তার কোন উল্লেখ নেই।

 

অভিজ্ঞ মহলের অভিযোগ নিয়মিত বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় খাদ্যে ইচ্ছেমত বিষ প্রয়োগ করছে অসাধূ ব্যবসায়ীরা। আর এতে করে নানারকম রোগব্যাধি আগলে ধরে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে সাধারণ মানুষ। এমনি অনেকেই অকালে মৃত্যুবরণ করছে এসব খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে।

 

সচেতন মহলের নানান অভিযোগের প্রেক্ষিতে চলতি বছরে নামি দামি ব্র্যান্ডের বেকারি ও স্নাকস কারখানায় হানা দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত। ফুটে উঠে খাদ্যে বিষক্রিয়ার চিত্র। মদুবন, বনফুল, ফুলকলি, স্বাদ ও ফ্লেভারসের মতো নামি দামি প্রতিষ্ঠানকে করা হয় লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা।কঠোর কোন আইন না থাকায় থামছে না খাদ্যে ভেজাল।

 

খাদ্যে ভেজাল রোধে র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালতের সর্বশেষ অভিযানটি চলে গতকাল রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। নোংরা কালো পুরাতন বেকারী তৈরি প্রস্তুত করার অপরাধে জরিমানা গুনতে হয় বাংলাদেশের অন্যতম সুনামধন্য বিখ্যাত বেকারী প্রতিষ্ঠান ‘‘কিষোয়ান স্ল্যাকস লিমিটেড”কে। একই অভিযানে বিএসটিআই লাইসেন্স ছাড়া বেকারী পণ্য তৈরি ও অবৈধ স্পন্স কেক তৈরীর অপরাধে জরিমানা করা হয় চট্টগ্রামের পরিচিত বেকারী ফ্যাশন ফুড এবং কুপার্স বেকারীকে।

 

রবিবার র‌্যাবের সিনিয়র এএসপি মো. সোহেল মাহমুদ, র‌্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনিসুর রহমান এবং বিএসটিআই’র মাঠ কর্মকর্তা মো. জিশান আহমেদ তালকুদারের সহায়তায় এ অভিযান পরিচালনা করে এসব প্রতিষ্ঠানকে পৃথক পৃথক জরিমানা করা হয়।

 

র‌্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনিসুর রহমান জানায়, বাংলাদেশের অন্যতম সুনামধন্য বিখ্যাত বেকারী ‘‘কিষোয়ান স্ল্যাকস লিমিটেড”। যারা নিত্য প্রয়োজনীয় টোস্ট বিস্কুট, কেকসহ বিভিন্ন ধরনের বেকারী সামগ্রী উৎপাদন করে বিক্রয় করে। অভিজ্ঞ মহলের নানান অভিযোগের ভিত্তিতে রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় সরেজমিনে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

 

তিনি বলেন, নাসিরাবাদ ষোলশহর বিসিক শিল্প নগরীর ফ্লট এ-৬, ব্লক-ডিতে কিষোয়ান বেকারীর কারখানায় গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, অত্যান্ত নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেকারী সামগ্রী তৈরী হচ্ছে। এখানকার কর্মিরা কোন রকমের হাত গ্লোবস ব্যবহার না করেই খালী হাতে ময়দার খামী থেকে বিস্কুট তৈরী করছে। এছাড়াও এ সময় ময়দার খামীর উপর ময়লা থাকতে দেখা যায়। সেখানে অত্যান্ত নোংরা কালো পুরাতন তেল পাওয়া যায়, যা দিয়ে বেকারী সামগ্রী তৈরী হচ্ছিল।

 

এ সমস্ত অপরাধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর ৫২ ধারা মোতাবেক “কিষোয়ান স্ল্যাকস লিমিটেড” এর সহকারী মহা ব্যবস্থাপক কাজী আসাদুজ্জামান (৪৩), জেনারেল ম্যানেজার মোঃ কপিল উদ্দিন চৌধুরী (৪১), ফ্লোর ইনচার্জ আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩০), এবং ফ্লোর ইনচার্জ মোঃ সাইদুজ্জামান (৩০) কে ১ লক্ষ টাকা করে সর্বমোট ০৪ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়।

 

রবিবার র‌্যাবের সিনিয়র এএসপি মো. সোহেল মাহমুদ জানায় প্রায় একই চিত্র নগরীর পরিচিত বেকারী ফ্যাশন ফুডেও। রবিবারের অভিযানে দেখা যায়, এ বেকারী বিএসটিআই এর কোন প্রকার লাইসেন্স ছাড়াই অবৈধভাবে বেকারী সামগ্রী উৎপাদন করে বিক্রয় করছে। বিএসটিআই এর লাইসেন্স না থাকায় বিএসটিআই অধ্যাদেশ ১৯৮৫ (সংশোধনী ২০০৩) এর ১৯, ২৪ ধারা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর ৫২ ধারা মোতাবেক “ফ্যাশন ফুড” এর মালিক সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী (৪০)কে ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয় এবং ম্যানেজার মোঃ মাইনুদ্দিন (৩০)কে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

 

এছাড়া দামপাড়ার সিডিএ অ্যাভেনিউর কুপার্স বেকারিও বিএসটিআই’র লাইসেন্স ছাড়াই অবৈধভাবে কেক তৈরি করার অপরাধে ম্যানেজার মলয় বড়ুয়া (৪৮) এবং বিক্রয় প্রতিনিধি ফারহান চৌধুরীকে (২৯) বিএসটিআই অধ্যাদেশ ১৯৮৫ (সংশোধনী ২০০৩) এর ২৪, ৩১(ক) ধারা মোতাবেক ৫০ হাজার টাকা করে মোট ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় বলে জানিয়েছে এ কর্মকর্তা।

আদায়কৃত জরিমানার সর্বমোট ০৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন বিএসটিআই’র মাঠ কর্মকর্তা মো. জিশান আহমেদ তালকুদার।

 

অন্যদিকে বেকারি  ভেজাল নাস্তা পন্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উৎপাদন এবং পচা ডিম ব্যবহারসহ সরকার অনুমতি বিহীন বেকারিগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ভেজাল বিরোধী অভিযান চালানোর দাবিতে গত ২ নভেম্বর চট্টগ্রাম বেকারি মালিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিনের বরাবরে সম্প্রতি একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।

স্মারক লিপির জবাবে জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন বলেন, স্বাস্থ্যসম্মত সুখাদ্য উৎপাদনের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম শহর ও শহরের আশপাশ এলাকায় নামিদামি ও অভিধভাবে গড়ে উঠা বেকারিগুলোতে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান অব্যাহত আছে। যে সব বেকারিতে ভেজাল পণ্য উৎপাদন হয় এবং সরকার অনুমোদন বিহীন বেকারি সমূহকে চিহ্নিত করে চট্টগ্রাম বেকারি মালিক সমিতির সহযোগীতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হবে। যত্রতত্র নগরীতে গড়ে উঠা নামে মাত্র বেকারি যেন প্রতিষ্ঠা না হয় তার জন্য বেকারি মালিক সমিতিকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান জেলঅ প্রশাসক।

 

রিপোর্ট : রাজীব সেন প্রিন্স

এ এস / জি এম এম / আর এস পি :::

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!