কোন পথে ইয়েমেন সঙ্কট?

Dr.-Anis

 

 

 

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান

ইয়েমেন এখন গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত । হুথিদের উপর জুলুম-নিপীড়ন চালিয়েও ক্ষমতায় টিকে না পেরে সুন্নিপন্থী প্রেসিডেন্ট আবদ-রাব্বু মানসুর হাদি এরই মধ্যে গোপনে দেশ ছেড়ে সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছেন। পার্লামেন্ট অকার্যকর। ভেঙে পড়েছে গোটা প্রশাসন ব্যবস্থা। ফলে দেশটিতে এখন এক চরম অরাজক পরিস্থিতি চলছে।

 

এই সঙ্কটের আগুনে ঘি ঢেলেছে প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরব। এরমধ্যে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ১০টি সুন্নীপন্থী রাষ্ট্রের একটি জোট ইয়েমেনের উপর রাত-দিন বিমান হামলা চালাচ্ছে। গোষ্ঠীগত বিরোধে গৃহযুদ্ধ এখন যুদ্ধে রুপ নিয়েছে। এ হামলায় মারা যাচ্ছে বিদ্রোহীসহ বেসামরিক সাধারণ মানুষও। সানা ও উত্তর ইয়েমেনের অনেক সর্বত্রই এখন বিভীষিকাময় অবস্থা। এ হামলায় সমর্থন দিয়েছে তেলসমৃদ্ধ পাঁচ দেশের জোট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি), মিশর, সুদান, পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশও। মিশরের যুদ্ধবিমানও হামলায় অংশ নিয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে জাতিসংঘ ও বিশ্ব মোড়লরা এ ব্যাপারে নীরব ভুমিকা পালন করে চলেছে।

 

হামলাকারীরা হাদি সরকার পুনর্বহাল না হওয়া পর্যন্ত সামরিক শক্তি প্রয়োগ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।অন্যদিকে বিশ্বের একমাত্র শিয়া অধ্যুষিত দেশ ইরান এই হামলার বিরোধিতা করছে। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এই সুযোগে ঘোলাপানি মাছ শিকার করতে চাইছে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলো। এতে তাদের উদ্দেশ্য বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা বাড়ানো। যাতে মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে। ইরান এসব দেশের হামলার বিরোধিতা করলেও ইরানকে তারা খুব বেশী চটাতে চাচ্ছে না- এমনটি ধারণা করা হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কেননা, কোনো কারণে সৌদির হামলার প্রেক্ষিতে ইরান পাল্টা হামলায় জড়িয়ে পড়লে বিশ্বে আরেকটি মহাযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়তে পারে। যদিও এই মুহূর্তে ইয়েমেন ইস্যুতে ইরানের যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

 

ইয়েমেন কেন এই সঙ্কটে, আর কেনই বা সৌদি আরবের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের ১০টি দেশ জোটবদ্ধ হয়ে এই হামলায় জড়িয়ে পড়লো, আর কী কারণেই বা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশগুলোও এই হামলাকে সমর্থন যুগাচ্ছে? আর কেনইবা বিশ্ব মোড়লরা এ ব্যাপারে নীরব। এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার মধ্যেই ইয়েমেন সঙ্কটের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে।

 

যতদূর জানা যায় তাতে, দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন থাকার পর ১৯৬৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হয়ে উত্তর ইয়েমেন ও দক্ষিণ ইয়েমেন নামে দুটো নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হয়। পরে ১৯৯০ সালে দুই ইয়েমেন আবারও এক হয়।কিন্তু বছর তিনেক না পেরোতেই ১৯৯৪ সালে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দেশটি। পরবর্তীতে ২০০৪ সালেও পুনরায় গৃহযুদ্ধে জড়ায়। প্রসঙ্গত, এসব গৃহযুদ্ধেও না গলিয়েছিল প্রতিবেশী সৌদি আরব ও ইরান।

 

প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে আড়াই কোটি জনতার বাস।প্রায় অর্ধেক শিয়া মুসলমান। হুথিরাও শিয়া । উত্তর ইয়েমেনের শিয়া আলেম বদর উদ্দিন আল হুথির নাম অনুসারে এই প্রতিরোধ আন্দোলনের নামকরণ করা হয়। বদর উদ্দিন আল হুথির এক ছেলে হোসেন আল হুথি সরকারী বাহিনীর হাতে এর আগেই নিহত হয়েছেন। অপর ছেলে আব্দুল মালিক আল হুথি বর্তমানে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে দক্ষিণ ইয়েমেন সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। দেশটির জনগণ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীবদ্ধ হলেও ক্ষমতা ভোগ করে আসছে সু্ন্নিরা। ফলে বরাবরই শিয়াপন্থী হুথিরা বঞ্চিত ও জুলুম-নির্যাতিত হবার অভিযোগ করে আসছে।

 

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হলেও ভূ-রাজনৈতিক বিচারে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। আর এ কারণে বহি:হস্তক্ষেপে দেশটির রাজনৈতিক সঙ্কট কখনোই দূরীভূত হয়নি। এতে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্মসহ সবকিছুকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে আসছে। গোষ্ঠী দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে গৃহযুদ্ধের বিষয়টি ছাড়াও ইয়েমেন অর্থনৈতিকভাবে বরাবরই এই অঞ্চলে পশ্চাত্পদ রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচিত। দেশটির প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যখন ব্যাপক অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, ইয়েমেন তখন ক্রমাগত দারিদ্র্যের কবলে নিমজ্জিত। মাত্র ১২০০ মার্কিন ডলারের মাথা পিছু আয় নিয়ে দেশটি কোনো মতে টিকে আছে।

 

এদিকে ১৯৯০ সালের দুই ইয়েমেন একত্রিত হলেও ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো সরাসরি নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। ক্ষমতাত্যাগী হাদী সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে দীর্ঘ সময় আলী আবদুল্লাহ সালেহ ঐক্যবদ্ধ ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনিও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের শিকার হয়েছিলেন। শিয়া গ্রুপ সব সময়ই ক্ষমতাসীন সরকারের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে আসছে।

সঙ্কটের পেছনে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্ব রাজনীতি: এমনিতেই দীর্ঘকাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নানা সঙ্কট চলে আসছে। অস্ত্রের খোড়া যুক্তিতে ইরাক গুঁড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা। একইভাবে ধ্বংস করা হয় লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসন। এসময় সৌদি আরব নীরব ছিল।

 

কিন্তু মিশরে গণ-আন্দোলনে হোসনি মোবারকের পতনের পর গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির ক্ষমতাসীন হলে টনক নড়ে সৌদির। সেনাবাহিনী মুরসিকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। এতে মহাখুশি সৌদি আরব। সিসিকে পুরস্কার হিসেবে কয়েক বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় সৌদি আরব ও কাতার। কারণ রাজতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে সৌদি আরব সবসময়ই গণতন্ত্রকামীদের ভয় পায়। এজন্য মিশরে গণতন্ত্রের মৃত্যুতে বেজায় খুশি সৌদির রাজপরিবার।

 

এদিকে সিরিয়ায় স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ জনগণ লড়াই করে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। এই সুযোগে ইরাকের মতো একই অজুহাত সেই ভয়ংকর মারণাস্ত্র, রাসায়নিক অস্ত্র মজুত রাখার অপরাধে সিরিয়ায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। সৌদি আরব তাতে সমর্থন জুগিয়ে গেছে। সিরিয়ায় বিদ্রোহী সুন্নি যোদ্ধাদের সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব। কিন্তু কেন? স্বার্থ একটাই, এতে অশান্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং গণতন্ত্রকামীরা পরাভুত হবে। আর এতে নিরাপদে থাকতে পারবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের রাজপরিবারের শাসকরা।

 

এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে নাটের গুরু যুক্তরাষ্ট্রই। ইরান পরমাণু অস্ত্র বানাল কি বানাল না, তার কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু ইসরায়েলের বিপুল পরমাণু বোমা থাকলেও সেদিকে কথা নেই তাদের। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাদের নাকি এসব বোমা দরকার। প্রতিবেশীর হাতে যখন পারমাণবিক বোমা, তখন ইরানেরও তা চায়। না হলে ইসরায়েলকে ‘মোড়ল’ মানতে হবে।

 

কিন্তু এব্যাপারে বেশী দূর এগোয়নি ইরান। তারা দাবি করছে, শান্তিপূর্ণ কাজে পরমাণু কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। তা মানছে না ইসরায়েল। ইসরায়েল দাবি করেছে, পরমাণু বোমা তৈরির কাজ ৭৫ ভাগ শেষ করেছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্র ও পরাশক্তির অন্য দেশ চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং জার্মানি ইরানকে নিরস্ত্র করতে দিনের পর দিন বৈঠক করে যাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে গত আট দিন ধরে আলোচনার পর গত বৃহস্পতিবার ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছে তেহরান ও ছয় বিশ্বশক্তি

 

বর্তমানে ইয়েমেন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট অনেক গভীরে। গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব যতটা না জটিল করেছে এরচেয়েও বেশী করেছে আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতি। বর্তমানে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের ফলে ইয়েমেন সঙ্কটটিকে এক ধরনের যুদ্ধে রূপ দিয়েছে। একদিকে ইরান সমর্থিত শিয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী, অন্যদিকে সৌদি আরবসহ সুন্নী রাষ্ট্রসমূহের সমর্থনপুষ্ট ইয়েমেন সরকার। তবে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের বিষয়টি ইয়েমেনে অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। ১৯৬০-এর দশকে মিশরের নাসের সরকার বিমানবাহিনী পাঠিয়েছিল তত্কালীন রিপাবলিকান পন্থিদের সাহায্য করবার জন্য। তাছাড়া যখনই ইয়েমেনে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে তখনই সৌদি আরব ইরানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে।

 

ইয়েমেনের বর্তমান সঙ্কটটি মধ্যপ্রাচ্যের ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিয়া-সুন্নীর বিরোধে হুথি বিদ্রোহীরা চাচ্ছে শিয়াদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। অন্যদিকে সুন্নীগোষ্ঠী হাদী সরকারের অবস্থানকে চাচ্ছে আরও সুদৃঢ় করতে। আর লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব চাচ্ছে ইয়েমেনে তাদের ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব কিংবা আরব লীগ তাদের হয়ে কাজ করছে। ফলে দেখা যাচ্ছে ইয়েমেন রাষ্ট্রটি গভীর থেকে গভীরতর সঙ্কটে নিপতিত হচ্ছে। ফলে এই সংকট থেকে বের হওয়া খুব সহজ হবে না।

 

প্রসঙ্গত, এই সঙ্কটে বাংলাদেশও যুক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সামরিক জোটের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশও এই জোটকে বিভিন্নভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। অন্যদিকে রাশিয়া এবং চীন কৌশলগতভাবে এক ধরনের নিরবতা পালন করছে, তাদের এই নীরবতা হয়তো ইরানের অবস্থানকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে। বাংলাদেশের এই সমর্থন মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত এবং আরব আমিরাতে শ্রম বাজারের উপর নির্ভরশীলতার কারণে। ফলে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটা কৌশলগত।

 

এছাড়া ইয়েমেনে আটকা পড়া ৫ হাজার বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয় দুই কর্মকর্তাকে ইয়েমেনে পাঠানোর কথা জানিয়েছেন।

 

তবে আজকের ইয়েমেনের এই সঙ্কটের জন্য শুধু হুথিরাই দায়ি নয়। বরং বিভিন্নসময়ে যারা ক্ষমতায় থেকেছেন তারা এই সঙ্কটকে জটিল করেছেন। ২০০৯ সালেও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ইয়েমেনের সেনাবাহিনী যুদ্ধ বিরতি লংঘন করে হুথি যোদ্ধাদের উপর প্রথমে হামলা চালালে তীব্র সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে সঙ্কটের দায় সুন্নী শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। তারা যদি আপোষকামী মনোভাব পোষণ করতো তা হলে অবশ্যই তারা হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসত। তাদের দাবিগুলো শুনত। অন্যদিকে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চালাতে পারতো সৌদি আরব। কিন্তু সেদিকে হাঁটেনি সৌদি সরকার। সোজাসুজি যুদ্ধের পথ বেঁছে নিল দেশটি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ইয়েমেন ও সেখাকার গণতন্ত্রকামীরা। তবে এই হামলায় সৌদী আরব কতটা সফল ও লাভবান হবে সেটা নিয়ে সবার মাঝে সন্দেহ-সংশয় রয়েছে। সাময়িকভাবে লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে সৌদী আরবকেও এর মাসুল গুণতে হবে। কেননা, ইয়েমেনের শিয়া হুথিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রভাব সৌদি আরবের শিয়াদের উপরও পড়তে পারে। এই আশংকায় সৌদি নেতৃবৃন্দ নিজেকে এই যুদ্ধে জড়িয়েছে। সৌদি আরবের ইয়েমেন সীমান্তের কয়েকটি শহরে শিয়া মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ইয়েমেনের সা’দা প্রদেশের অধিবাসীদের সাথে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। সৌদি শিয়া মুসলমানরাও তাদের সাথে সরকার বৈষম্যমূলক আচরণ করছে বলে অভিযোগ করে আসছে। সৌদি আরব মনে করছে, ইয়েমেনে হুথিদের নিশ্চিহ্ন করা গেলে সৌদি শিয়া মুসলমানরা চীরতরে স্তব্ধ হয়ে যাবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা।

 

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরব জড়িয়ে পড়ায় সমস্যার সমাধান আরও জটিল হয়ে পড়েছে এবং তা কোন পক্ষের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। সৌদি আরব হুথিদের উপর হামলার মাধ্যমে মারাত্বক ভুল করেছে বলেই তারা মনে করছেন। হুথিদের বিরুদ্ধে সৌদি আরব ও মিত্র জোটের বাহিনীর ব্যাপক হামলায় বহু বেসামরিক মানুষ হতাহত হচ্ছে। বহু মানুষ ঘরবাড়ী হারিয়ে খোলা আকাশের নীচে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। সৌদি ও মিত্র জোটের জঙ্গী বিমানগুলো উত্তর ইয়েমেনের আবাসিক এলাকা এবং হাট-বাজারেও নির্বিচারে বোমা বর্ষন করেছে।

 

এদিকে ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধারা সেখানকার শিয়া মুসলমানদের সাথে সুন্নী শাসকগোষ্ঠীর বরাবরই বৈষম্য ও অন্যায় আচরনের প্রতিবাদে সংগ্রাম করলেও কোন কোন মিডিয়া তাদেরকে সন্ত্রাসী ও আল-কায়েদাপন্থী বলে প্রচার চালাচ্ছে। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, আকিদাগত ও রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে শিয়া মুসলমান ও উগ্র আলকায়েদার মধ্যে সুস্পষ্ট মৌলিক বিরোধ রয়েছে।

 

ইয়েমেনের হুথি নেতা আলকায়েদা সম্পর্কে বলেছেন, আল কায়েদা গোষ্ঠী হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়নক এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য এই গোষ্ঠীকে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া হুথি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ইরানের সাথে যোগাযোগের অভিযোগ আনা হচ্ছে। এমন সময় এই অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে যখন ইরান শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইয়েমেন সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়ে আসছে।

 

ফলে বলা যায়, ইয়েমেন সঙ্কটের প্রভাব এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। ভূ-রাজনীতিসহ বিভিন্ন কারণেই এই সঙ্কটটি অত্যন্ত জটিল। তবে ইয়েমেনের বেসামরিক জনগণের স্বার্থের বিবেচনায় এর দ্রুত সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। আর এই সঙ্কটের সমাধান সামরিক শক্তি প্রয়োগে ইয়েমেনের পদত্যাগী সরকারকে জোরপূর্বক পুনর্বাসিত নয়। মূলত: দেশটির রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ প্রক্রিয়াই হতে পারে শান্তিপূর্ণ উপায়। সৌদি আরব সব সময় ইয়েমেনের জনগণের সাথে শত্রুতা করেছে। এবার হামলার মাধ্যমে ইয়েমেনের স্বার্বভৌমত্ব লংঘন করেছে।সৌদি আরবের এই পদক্ষেপ শিয়া-সুন্নী কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। তবে শিয়া মুসলমানদের প্রতি সুন্নী মুসলমানদের সহমর্মিতা বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ ইয়েমেনের সুন্নীরা শাফিয়ী মাজহাবের। শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গী ও বিশ্বাসের সাথে শাফিয়ীদের দৃষ্টিভঙ্গী ও বিশ্বাসের অনেক মিল রয়েছে এবং তারা সৌদি ওহাবী মতবাদের বিরোধী।এছাড়া বাস্তবতা হলো, যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে বেসামরিক জনগণসহ গোটা দেশের ক্ষতিও তত বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় সবপক্ষের উচিত শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা।

 

ফলে অবিলম্বে ইয়েমেনে বিমান হামলা বন্ধ হওয়া উচিত। অন্যথা বিশ্বসম্প্রদায়ের নীরবতায় অনাকাঙ্খিত এই হামলা ও যুদ্ধে যে প্রাণহানি-মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষয়ক্ষতি হবে এ জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্বমোড়লরাই দায়ি থাকবেন।#

লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক।ই-মেইল: [email protected]           

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!