বিশ্বের সবচে ধনী, সবচে রহস্যময় পরিবার রথচাইল্ড

বিশ্বের সবচে ধনী, সবচে রহস্যময় পরিবার রথচাইল্ড 1আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য পরিবার হওয়ার পাশাপাশি সম্ভবত সবচেয়ে রহস্যময় পরিবারও ইউরোপের রথচাইল্ড ফ্যামিলি। আঠারো শতকের ষাটের দশকে ব্যাংকিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আজকের অবস্থানে উঠে আসে এই ইহুদি পরিবার। গত কয়েক শতক ধরে এদের নিয়ে প্রচলিত আছে বহু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। কেউ কেউ এসব সত্য বলে মানেন। আবার কেউ নিছক ষড়যন্ত্রই মনে করেন।

ব্যবসার শুরু থেকেই কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করে আসছে রথচাইল্ড। আর এ কারণেই হয়তো সাধারণের কাছে রহস্য হয়েই থাকে পরিবারটি। তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ কখনোই কাউকে জানানো হয় না। ধারণা করা হয় প্রায় এক লাখ কোটি ডলারের মালিক তারা। তবে রথচাইল্ডের শুরুটা কিন্তু হয়েছিল একেবারে সাদামাটাভাবে। অবশ্য কৌশলটা ছিল বেশ সূক্ষ্ম। সেই জোরেই রথচাইল্ড এখন ‘ব্যাংক অব দ্য ব্যাংকস’, ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য গভর্নমেন্টস’।

এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মায়ার আমসেল রথচাইল্ডের জন্ম ১৭৪৪ সালে এক জার্মান ইহুদি পরিবারে। বাবা মোজেস আমসেল বাউয়ার ছিলেন একজন মহাজনী ব্যবসায়ী ও স্বর্ণকার। ছোটবেলা থেকেই ছেলেকে সুদী ব্যবসা শিক্ষা দিতে শুরু করেন তিনি। সেই সঙ্গে রথচাইল্ডকে ইহুদি রাব্বি বানানোরও স্বপ্ন ছিল তার। ১৭৫৫ সালে মারা যান মোজেস। এরপর হ্যানোভারের একটি ব্যাংকে কাজ শুরু করেন রথচাইল্ড। অসাধারণ কৌশল আর মেধা কাজে লাগিয়ে অল্প সময়েই হয়ে যান প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র পার্টনার।

ব্যস, সেই থেকে শুরু। আর পেছনে ফিরতে হয়নি মায়ার রথচাইল্ডকে। হ্যানোভারে কাজ করার সময় ইউরোপের প্রায় প্রতিটি রাজপরিবারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় আরেক ব্যবসায়ী উইলিয়ামের সঙ্গে। কোনো একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডেনমার্কে পালিয়ে যেতে হয়েছিল উইলিয়ামকে। আর তখন তিনি রথচাইল্ডকে দিয়ে যান ৬০ হাজার পাউন্ড, যার তৎকালীন মূল্যমান প্রায় ৩০ লাখ মার্কিন ডলার।
বিশ্বের সবচে ধনী, সবচে রহস্যময় পরিবার রথচাইল্ড 2

রথচাইল্ড পরিবারের নেতৃত্বে যারা
পাঁচ সন্তানের জনক মায়ার রথচাইল্ড মার্চেন্ট ব্যাংক খোলার জন্য তার চার ছেলেকে পাঠিয়ে দেন ইউরোপের চার সমৃদ্ধ শহর নেপলস (ইতালি), প্যারিস (ফ্রান্স), ভিয়েনা (অস্ট্রিয়া), ও লন্ডনে (যুক্তরাজ্য)। আরেক ছেলেকে রেখে দেন ফ্রাঙ্কফুর্টে। এই পাঁচ শহরে থেকে ইউরোপজুড়ে নিজেদের অর্থনৈতিক রাজ্য গড়ে তোলেন রথচাইল্ডের সন্তানরা। ১৮১২ সালে মারা যান মায়ার আমসেল রথচাইল্ড। এরপর ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বে আসেন তার ছেলে নাথান রথচাইল্ড।

বিভিন্ন দেশের সরকার এবং প্রতিষ্ঠানকে উচ্চ সুদে ঋণদানই ছিল রথচাইল্ড পরিবারের মূল ব্যবসা। এর পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের ব্যবসাও ছিল তাদের। বলা হয়ে থাকে, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে উভয় সরকারকেই ঋণ দিতো রথচাইল্ড। বিনিময়ে বন্ধক রাখতে হতো রাষ্ট্রের জমিজমা আর ধন-সম্পদ। পাঁচ ভাই পাঁচ দেশে থাকার কারণে কাজটি বেশ সুবিধাজনক ছিল তাদের জন্য। যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক, লাভ গুণতো রথচাইল্ড।

যেমন: ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের মধ্যকার ওয়াটারলুর যুদ্ধে দুই দেশকেই ঋণ দিয়েছিল তারা। ওই যুদ্ধে শুধু ১৮১৫ সালেই ব্রিটেনের মিত্রদের ৯৮ লাখ পাউন্ড ঋণ দিয়েছিল তারা, বর্তমান হিসাবে তা প্রায় ১ হাজার ১ কোটি মার্কিন ডলারের সমান। তখন এর পাশাপাশি আরো একটি লাভজনক ব্যবসা চালাতে পেরেছিল রথচাইল্ড পরিবার। ওয়াটারলুর যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে সব ধরনের জাহাজ চলাচলই ছিল বন্ধ। চলতো শুধু এই পরিবারটির জাহাজ। কারণ দুই দেশের সরকারই তাদের জাহাজের নিরাপত্তা দিত।

ওই যুদ্ধের পর রথচাইল্ডের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যায় প্রায় ২০ গুণ। যুদ্ধকালীন ব্রিটেনের শেয়ারের দর পড়ে যাওয়ায় সব শেয়ার কিনে নেয় তারা। এভাবে পুরো ব্রিটিশ অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে আসে পরিবারটির হাতে। একই অবস্থা ছিল ফ্রান্সের। দেশটির সমস্ত বন্ড কিনে নিয়ে ১৮১৮ সালের ৫ নভেম্বর সবগুলো বাজারে ডাম্প করে তারা। এতে বিপর্যয় দেখা দেয় ফরাসি অর্থনীতিতে। সরকার ধরণা দিতে শুরু করে রথচাইল্ডের কাছে। এভাবে একে একে ব্রিটিশ, ফ্রান্সসহ ইউরোপের পুরো অর্থনীতি চলে আসে তাদের হাতে।

ব্যবসার ব্যাপারে গোপনীয়তা আর কঠোর নিয়ম কানুন মেনে চলে এই ব্যবসায়ী পরিবার। নিজেদের বাণিজ্য কখনোই পরিবারের বাইরে যেতে দেয়নি। এমনকি মেয়েদের ব্যবসায়ে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আছে কঠিন নিষেধাজ্ঞা। সম্পদ রক্ষার জন্য পরিবারের

মধ্যেই মেয়েদের বিয়ে দেয়ার রীতিও আছে।

উনিশ শতকের শুরুর দিক থেকেই মূলত ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনীতি আর রাজনীতির নিয়ন্তা হয়ে ওঠে রথচাইল্ড।

১৮৭৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণেতা হন এই পরিবারের লিওনেল রথচাইল্ড। মিশরের সুয়েজ খাল নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্রিটিশ সরকারকে রাজি করাতে পারেন তিনি। আর এজন্য যুক্তরাজ্যকে ৪০ লাখ পাউন্ড ঋণদানেও সমর্থ হন। তখন থেকে রাজনীতিও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরু করে এই পরিবার। বলা হয়ে থাকে, সারা পৃথিবীতে অসংখ্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আছে তাদের। কিন্তু কখনোই এসবের তথ্য প্রকাশ করে না তারা।
বিশ্বের সবচে ধনী, সবচে রহস্যময় পরিবার রথচাইল্ড 3রথচাইল্ড পরিবারের সদস্যরা
প্রায় ২০০ বছর ধরে এই রথচাইল্ডকে নিয়ে আছে অনেক রহস্য। কারো কাছে এসব স্রেফ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, আবার কারো কাছে বাস্তবতা। ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা বলেন- ফরাসি বিপ্লব, ওয়াটারলুর যুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রুশ বিপ্লব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, এমনকি হিটলারের হলোকাস্ট- এর সব কিছুর পেছনেই ভূমিকা আছে রথচাইল্ড পরিবারের। নিজেদের ব্যবসার স্বার্থেই এসব করেছে তারা। সঙ্গে কাজ করেছে ধর্মীয় অনুভূতিও।

১৯১৯ সালের ২৯ মার্চ বলশেভিক বিপ্লব বিষয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যম টাইমস অব লন্ডন এক প্রতিবেদনে বলে, ‘বলশেভিক বিপ্লবের ব্যাপারে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপারটি হচ্ছে- এর নেতাদের একটি বিরাট অংশই রুশ নয়। বিপ্লবের মূলে ভূমিকা রাখা ২০ থেকে ৩০ নেতার মধ্যে ইহুদির হার ৭৫ ভাগের কম হবে না। ভ্লাদিমির লেনিন নিজেও ইহুদি।’

তবে পরে নাকি রুশদের সঙ্গে আর মিলে থাকা সম্ভব হয়নি রথচাইল্ডের। কারণ বিপ্লবের সময় কথা ছিল, কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না সরকার। পরে সে কথা রাখেনি বলশেভিক সরকার।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে রথচাইল্ডের ভূমিকার কথাও বলে থাকেন অনেকে। ইসরায়েলকে যাতে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় সেজন্য ৩৩তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেনরি এস ট্রুম্যানকে ২০ লাখ ডলার দিয়েছিল তারা। নির্বাচনী প্রচারণা তহবিলের নামে দেয়া হয়েছিল ওই অর্থ। পরে যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েলকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। চীনের মাও সে তুংয়ের বিপ্লবেও নাকি অর্থ দিয়েছিল রথচাইল্ড!

এসব তত্ত্বের কোনটা সঠিক, আর কোনটা ভুল- তা যাচাই করা কঠিন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বের ধনাঢ্য পরিবারের তালিকায় শীর্ষেই থাকছে রথচাইল্ড। আর সেই সঙ্গে হয়ে আছে রহস্যময়।

সূত্র: বিবিসি, উইকিপেডিয়া।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!