ভারত-সাম্রাজ্য জয় করে ফাইনালে নিউজিল্যান্ড

শ্বাসরুদ্ধকর সেমিতে নিউজিল্যান্ডের ১৮ রানের জয়

ভারত-এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে ফেভারিট দল হিসেবে অনেকেই ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ কারা হচ্ছে সেটিই ভাবছিলেন। অন্যদিকে, সেমিতে নিউজিল্যান্ডকে পাওয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছিল ভারত-অস্ট্রেলিয়া। চার দলের মধ্যে সবচেয়ে ‘দুর্বল’ দলটাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেলে যে ফাইনালের পথটা সহজ হয়! শ্রীলঙ্কা ম্যাচ জিতে যখন কিউইদের প্রতিপক্ষ হওয়াটা নিশ্চিত হল, আনন্দে ভাসছিলেন ভারতবাসীরা, দিব্যচোখে দেখছিলেন ফাইনালের রাস্তাটাও! কিন্তু ঘুণাক্ষরে কেউ টের পায়নি, কী অপেক্ষা করছে। পুরো আসরের যত বিষ সেমিতে ঢেলে দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল যে গতবারের রানার্সআপরা!

ভারত-সাম্রাজ্য জয় করে ফাইনালে নিউজিল্যান্ড 1
ওয়ান ম্যান আর্মির মতো একাই ভারতকে অবিশ্বাস্য জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জাদেজা।

ম্যানচেস্টারে বৃষ্টি বিভ্রাটে রিজার্ভ ডেতে গড়ানো প্রথম সেমিফাইনালে ৮ উইকেটে ২৩৯ রান তুলেছিল নিউজিল্যান্ড। টানা কয়েকদিন বৃষ্টির কামড় খাওয়া উইকেটে এই রানই যে সাড়ে তিনশোর সমান, সেটা মঙ্গলবার থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল! ভারত সেদিন ব্যাট করেনি, করেছে একদিন পর। তাতেও পড়ে গেল বিপদে। লম্বা সময় ঢেকে রাখা পিচে নিজেদের সহজাত সুইং কাজে লাগিয়ে কোহলিদের কাঁদালেন কিউই পেসাররা। ভারত ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে। শেষপর্যন্ত পারেনি। রূপকথা লিখতে লিখতে খুব কাছে থেমে ২২১ রানে অলআউট, ১৮ রানে হেরে নিয়েছে বিদায়। আর টানা দ্বিতীয় ফাইনালে উইলিয়ামসনের দল।

ভারত আসলে পুড়েছে কিউই পেসারদের আগুনে। দিনের শুরুর দিকে উইকেটের আদ্রতা আর সুইং দিয়ে তারা কাবু করে দিলেন ভারতীয়দের তারকাসমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইনআপকে। পরে একমাত্র স্পিনার হিসেবে মিচেল স্যান্টেনারও কম যাননি। আসলে উইকেট যে দুহাত পেতে বসে ছিল বোলারদের জন্যই।

দ্বিতীয় ওভার থেকেই ভারতের বিপর্যয়ের শুরু। উইকেটের পেছনে টম ল্যাথামের হাতে ক্যাচ দিয়ে বোকা বনে গেলেন ১ রান করা রোহিত শর্মা। ম্যাট হেনরির গুডলেন্থের বল এমনভাবে আউটসুইং করেছে যে, কখন ব্যাট স্পর্শ করল বল সেটা টেরই পাননি এক বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ পাঁচ সেঞ্চুরিয়ান রোহিত। দলের রান তখন সবে মাত্র ৪।

ভারত-সাম্রাজ্য জয় করে ফাইনালে নিউজিল্যান্ড 2
ডিরেক্ট থ্রো-তে স্টাম্পের লালবাতি জ্বলে উঠে বিদায় হয় ভারতের শেষ ভরসা ধোনির।

আর এক রান যোগ হতেই রোহিতের পথে সাজঘরে বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুল। তিনজনই আউট হয়েছেন নামের পাশে ১ করে যোগ দিয়ে। কাকতালীয়ই বটে!

তৃতীয় ওভারে ট্রেন্ট বোল্টের বল সোজা প্যাডে আঘাত হানলো কোহলির। আম্পায়ার রিচার্ড ইলিনওয়ার্থ সোজা আঙুল তুলে দিলেন। রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারলেন না ভারত অধিনায়ক। তার পরের ওভারেই ম্যাট হেনরির বল এতটাই বাঁক খেলো যে ব্যাট সরিয়েও বাঁচতে পারলেন না রাহুল। বল তার ব্যাট ছুঁয়ে সোজা উইকেটরক্ষক ল্যাথামের হাতে। ৫ রানেই সাজঘরে ভারতের টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান!

ভারত-সাম্রাজ্য জয় করে ফাইনালে নিউজিল্যান্ড 3
ছবিটি দেখলে বিশ্বাসই হবে না দলটির নাম ব্যাটিং লাইন আপের জন্য বিখ্যাত ভারত

এক ম্যাচে দুই অঙ্কের রান পাননি রোহিত-কোহলি, এমন ম্যাচ সবশেষ দেখা গেছে ২০১৭ সালে, পাকিস্তানের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে। শেষ পর্যন্ত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে ম্যাচটা হেরে গিয়েছিলো ভারত।

ব্যর্থ কোহলি নিজেও। বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ফাইনাল-সেমিফাইনালে খেললেই যেন খেলা ভুলে যান ওয়ানডের সেরা ব্যাটসম্যান। বিশ্বকাপের তিনটি সেমিতে খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। ২০১১, ২০১৫ ও ২০১৯ বিশ্বকাপে তার রাব যথাক্রমে ৯, ১,১!

সেরা ব্যাটসম্যানরা ফেরার পর যখন একটু প্রতিরোধের চেষ্টা, আবারও ঘাতক হেনরি। এবার শিকার দিনেশ কার্তিক। দশম ওভারের শেষে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে নিচু ক্যাচটি দারুণভাবে একহাতে জমান জিমি নিশাম। প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের মত তিন অঙ্কে পৌঁছানো হয়নি কার্তিকেরও।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:
নিউজিল্যান্ড: ২৩৯/৮ (৫০ ওভারে, উইলিয়ামসন ৬৭, টেলর ৭৪, গ্রান্ডোম ১৬, ভুবেনশ্বর ৩/৪৩, বুমরা ১/৩৯, জাদেজা ১/৩৪)।
ভারত: ২২১/১০ (৪৯.৩ ওভারে, পান্থ ৩২, পান্ডিয়া ৩২, ধোনি ৫০, জাদেজা ৭৭, হেনরি ৩/৩৭, বোল্ট ২/৪২, স্যান্টার ২/৩৪)।
ফল: নিউজিল্যান্ড ১৮ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা: ম্যাট হেনরি।

এরপর উইকেটপতনে খানিকটা বিরতি। টুকটুক করে ব্যাটিংয়ে ভারতবাসীর মরতে থাকা ফাইনাল স্বপ্ন যেন আবারও জীবিত করে তুলতে লাগলেন পান্ট ও হার্দিক পান্ডিয়া। দুজনের ব্যাটে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো ভারত।

কিন্তু সুখ সইলো না বেশীক্ষণ। উইকেট খুঁটি গেড়ে ব্যাটসম্যানদ্বয়ের জন্য স্পিনের ফাঁদ পাতলেন কিউই দলপতি কেন উইলিয়ামসন। আর তাতে পা দিয়ে বসলেন রিশভ পান্ট। মিচেল স্যান্টনারের নিরীহ দর্শন বলকে ধৈর্য হারিয়ে উড়িয়ে মিড অন দিয়ে বাইরে পাঠাতে চাইলেন। কিন্তু সেখানে যে আগেই কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম ওঁত পেতে ছিলেন। তাকে ক্যাচ দিয়ে ৩২ রানে কাঁটা পড়লেন পান্ট।

ঠিক একইরানে ফিরতে হলো হার্দিক পান্ডিয়াকেও। এবারও শিকারি স্যান্টনার। রান চড়তে থাকায় একটু হাত খুলতে চেয়েছিলেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। কিন্তু তার স্লগ সুইপটা কাজে লাগলো না। মিডউইকেট বরাবর উঠে গেলো ক্যাচ। উইলিয়ামসনের ক্যাচ নিতে কোন সমস্যাই হয়নি। ভারতের রান তখন ৬ উইকেটে মাত্র ৯২!

ভারত-সাম্রাজ্য জয় করে ফাইনালে নিউজিল্যান্ড 4
ভারতের একেকটি উইকেটের পর এভাবেই উল্লাসে মেতে উঠে নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়ে।

কিন্তু সেখান থেকেই ম্যাচ জমিয়ে দিলেন রবীন্দ্র জাদেজা। এসেই শুরু করলেন পাল্টা আক্রমণ। ৩৯ বলে তুলে নিলেন ফিফটি। অন্যপ্রান্তে তখনো সৌম্য-শান্ত ধোনি।

ক্রমেই ম্যাচটা কিউইদের হাত থেকে বের করে নিচ্ছিলেন ধোনি-জাদেজা জুটি। দ্রুতলয়ে উঠলো ১১৬ রান। একটা পর্যায়ে সমীকরণ দাঁড়ালো ২০ বলে ৩২।

কিন্তু সে অবস্থায় ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন ট্রেন্ট বোল্ট। ৫৯ বলে ৭৭ করা জাদেজাকে বানালেন উইলিয়ামসনের ক্যাচ। তার পরের ওভারেই ধোনি ৫০ রানে রান আউট হতেই সব আশা শেষ। ৪ বল বাকি থাকতেই হতাশা নেমে এলো ভারত শিবিরে।

এর আগে বৃষ্টিতে ম্যাচ বন্ধ হওয়ার আগে মঙ্গলবার ৪৬.১ ওভারে ৫ উইকেটে ২১১ রান তুলেছিলো নিউজিল্যান্ড। বুধবার ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয় ম্যাচ। আগের দিন ৬৭ রানে অপরাজিত থাকা ব্যাটসম্যান রস টেলর আর মাত্র ৭ রান যোগ করে আউট হন দলীয় সর্বোচ্চ ৭৪ রানে। আগের দিন ৬৭ করে আউট হয়েছিলেন অধিনায়ক উইলিয়ামসন।

ভারতের হয়ে তিন উইকেট নিয়ে সফল বোলার ভুবনেশ্বর কুমার। এছাড়া জাদেজা, চাহাল, পান্ডিয়া ও বুমরাহ নেন একটি করে উইকেট।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!