চিরায়ত ট্র্যাজেডির অপর নাম দক্ষিণ আফ্রিকা

নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ক্রিকেট সার্কিটে ফিরে আসার পর প্রতিটি বিশ্বকাপেই ফেবারিট হিসেবে যাত্রা শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা; কিন্তু শক্তিশালী দল হয়েও এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ জেতা হয়নি আফ্রিকার প্রতিনিধিদের। ১৯৯৮ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (তখনকার নক আউট বিশ্বকাপ) জয়ই এখন পর্যন্ত তাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।

৩০ মে এবারের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী দিনে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামবে দক্ষিণ আফ্রিকা। অর্থ্যাৎ বিশ্বকাপটাই শুরু হচ্ছে হাই প্রোফাইল একটি ম্যাচ দিয়ে। খেলা হবে লন্ডনের দ্য ওভালে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমানে দলটি টেস্ট র‌্যাংকিংয়ে দ্বিতীয় এবং ওয়ানডেতে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এছাড়া ১৯৯২, ১৯৯৯, ২০০৭ ও ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছিল তারা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ২১ বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে অধিনায়ক কেপলার ওয়েসেলসের হাত ধরে দক্ষিণ আফ্রিকা ত্রাস ছড়িয়েছিল ১৯৯২ বিশ্বকাপে।

কিন্তু নবজাগরণের পাশাপাশি কোনো টুর্নামেন্টে বাজে সমাপ্তির অধ্যায়টাও শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। সাদা বিদ্যুৎখ্যাত ফাস্ট বোলার অ্যালান ডোনাল্ড কিংবা হ্যানসি ক্রোনিয়ের মতো তারকা ব্যাটসম্যানের এ দলটি বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার হয়েও, সবাইকে অবাক করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রীলংকার কাছে হেরে যায়। শুধু তাই নয়, আসতে থাকে একের পর এক নিয়তির আঘাত।

বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের নিয়মনীতির চরম ব্যবহার বিশ্ব ক্রিকেট দেখল এ বিশ্বকাপেই। সেখানেও খগড় নেমে এলো তাদের ওপর। অনেক হিসাব কষে, শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকাকে দেওয়া হলো এক বলে ২২ রানের অজাগতিক এক টার্গেট। তাই অনেক ভালো খেলেও সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয় সম্ভাবনাময় দলটিকে।

১৯৯৬ বিশ্বকাপেও দক্ষিণ আফ্রিকা এসেছিল অপার সম্ভাবনা নিয়ে। প্রথম পর্বের খেলার সব ক’টিতে জয় নিয়ে নক আউট পর্বে উঠেছিল ক্রোনিয়ে-রোডস-কাস্টেনের দল; কিন্তু সেখানেই শেষ। সবাইকে অবাক করে ‘এ’ গ্রুপের প্রথম পর্বের পাঁচ ম্যাচের তিনটিতেই হেরে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে তারা ১৯ রানে ধরাশায়ী হয় কোয়ার্টার ফাইনালে।

ফলে আবারও স্বপ্নের যবনিকা। এরপর আসে ১৯৯৯-এর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ। এবারও প্রাথমিক পর্বের একটি বাদে বাকি ম্যাচগুলো জিতে গ্রুপসেরা হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা উঠে যায় সুপার সিক্সে। সেখানে তিন খেলায় জয় নিয়ে আশা জাগিয়ে সরাসরি সেমিফাইনালে উঠে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে শেষ চারের খেলায় প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টাই করে বসে আফ্রিকান দলটি। অ্যালান ডোনাল্ড আর ল্যান্স ক্লুজনারের ভুলে শেষ বলে এক রান নিতে না পেরে হয়ে যায় রানআউট। আবারও নিয়তির জালে আটকে যায় দলটি, রানরেটের হিসাবে বিদায় নিতে হয় বিশ্বকাপ থেকে।

২০০৩ বিশ্বকাপের অন্যতম আয়োজক হলেও এবারের শুরুটা আগের মতো হলো না আফ্রিকানদের। গ্রুপ পর্বের লড়াইয়ে ‘বি’ গ্রুপের চার নম্বরে অবস্থান নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাদের সুপার সিক্সে ঠাঁই মেলেনি। ফলে এখান থেকেই বিদায় নিতে হলো স্বাগতিকদের।

২০০৭ বিশ্বকাপেও দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের বিশ্বসেরা হয়ে ওঠার মিশন শুরু করেছিল বেশ ভালোভাবেই। গ্রুপ পর্ব তারা শেষ করেছিল দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে। এরপর সুপার এইটও ভালোভাবে উতরে যায় অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথের দল। তখন পর্যন্ত তাদের বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার হিসেবে ধরাও হচ্ছিল।
চিরায়ত ট্র্যাজেডির অপর নাম দক্ষিণ আফ্রিকা 1
সেমিফাইনালে এসে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় আফ্রিকান দেশটি। কিন্তু গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং শন টেইটের দুর্দান্ত বোলিংয়ের সামনে ১৪৯ রানেই মুখ থুবড়ে পড়ে প্রোটিয়াদের ইনিংস। অস্ট্রেলিয়া এ রান অতিক্রম করে মাত্র ৩১.৩ ওভারে। একই সঙ্গে টানা পঞ্চমবারের মতো ধূলিসাৎ হয়ে যায় অমিত প্রতিভাধর এ দলটির বিশ্বকাপ মিশন।

২০১১ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে ছিল প্রোটিয়াদের স্বপ্নের যাত্রা। গ্রায়েম স্মিথের নেতৃত্বে গ্রুপ পর্বে ৬ ম্যাচের মধ্যে ৫ ম্যাচে জিতে শীর্ষে থেকেই উঠেছে কোয়ার্টার ফাইনালে। ‘বি’ গ্রুপে সেবারের চ্যাম্পিয়ন ভারত হয়েছিল দ্বিতীয়। শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের কাছে হেরেছিল তারা, ১৭১ রানের জবাবে ১৬৫ রানে অলআউট হয়ে।

কিন্তু প্রোটিয়াদের দুর্ভাগ্য, কোয়ার্টার ফাইনালেই থেমে যায় তাদের স্বপ্নযাত্রা। নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে যায় ৪৯ রানে। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরে যায় নিজ দেশে। অথচ সেরা প্রোটিয়া কোচ গ্যারি কারস্টেনের অভিভাবকের অধীনে থেকে বিশ্বকাপ জয় করে নেয় ভারত।

২০১৫ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা খেলতে যায় এবি ডি ভিলিয়ার্সের নেতৃত্বে। এবারও শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকা। শিরোপার অন্যতম ফেবারিট। কিন্তু মোক্ষম সময়ে এসে ভেঙে পড়াটাই হচ্ছে তাদের ঐতিহ্য। গ্রুপ পর্বে ৬ ম্যাচের ৪টিতে জিতে হয়েছে দ্বিতীয়। কোয়ার্টার ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে ১৩৩ রানে অলআউট করে দিয়ে বীরদর্পেই তারা উঠে যায় সেমিফাইনালে। কিন্তু স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড এবারও তাদের পথের কাটা। অকল্যান্ডে বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে ৪ উইকেটে হেরে বিদায় নিতে হয় প্রোটিয়াদের।

এবারও তারা সবচেয়ে শক্তিশালী। ব্যাটিং-বোলিংয়ের বিচারে প্রোটিয়াদের চেয়ে শক্তিধর দেশ আর নেই। ফ্যাফ ডু প্লেসির নেতৃত্বে এই দলটিতে রয়েছেন হাশিম আমলা, এইডেন মারক্রাম, কুইন্টন ডি কক, ডেভিড মিলার, জেপি ডুমিনি, রাশি ফন ডার ডুসেনরা। তবে বোলিংয়েই যেন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে প্রোটিয়ারা।

কাগিসো রাবাদা তো রয়েছেন ফর্মের চূড়ায়। লুঙ্গি এনগিদি, ডেল স্টেইন, আন্দিল পেহলুকাইয়ো, ডোয়াইন প্রিটোরিয়াস, অ্যানরিখ নর্টজেরা রয়েছেন পেসারদের তালিকায়। এছাড়া ইমরান তাহির কিংবা তাবরিজ শামসিরা রয়েছেন স্পিনার হিসেবে। সুতরাং, এবারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা যদি শিরোপা জিতে যায়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

দক্ষিণ আফ্রিকা স্কোয়াড:
ফ্যাফ ডু প্লেসি (অধিনায়ক), জেপি ডুমিনি, ডেভিড মিলার, ডেল স্টেইন, আন্দিল পেহলুকাইয়ো, ইমরান তাহির, কাগিসো রাবাদা, ডোয়াইন প্রিটোরিয়াস, কুইন্টন ডি কক (উইকেটরক্ষক), এনরিখ নর্টজে, লুঙ্গি এনগিদি, এইডেন মারক্রাম, রাশি ফন ডার ডুসেন, হাশিম আমলা এবং তাবরিজ শামসি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!