শোকাবহ রাউজান!

 

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ  বজ্রকণ্ঠে এভাবে মুক্তির সংগ্রামের ডাক দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত তখন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের লড়াই শুরু হয়। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীরা তাদের রূপরেখা মতে নিরীহ, নিরস্ত্র, বাঙ্গালীদের নৃসংশভাবে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে।

 

২৫ মার্চ মধ্য রাতে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। এর পর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা যার যা কিছু আছে তা নিয়ে স্বাধীনতার লড়ায়ে ঝাপিয়ে পড়ে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে জানা যায়, তৎসময় চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার প্রায় ৬টি স্থানে গঠিত হয় মুক্তিসেনা সংগ্রহ ও সহায়ক কমিটি। এ সব কমিটি গুলোর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়প্রদানকারী, পথ প্রদর্শনকারী ও যোগাযোগ রক্ষাকারীরা এক সূত্রে গাঁথা ছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে গমন, ট্রেনিং শেষে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে যথাস্থানে পৌছাতে সহয়তা করেছিল।

 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা বাঙ্গালী নিধনে লিপ্ত হলে এদেশে তাদের তাদের দোসররা রাউজানে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতাকারী ও হিন্দু নিধনের নীল নকশা বস্তবায়ন করতে মত্ত থাকে।

শোকাবহ দিন ::

১৩ এপ্রিল ১৯৭১ রাউজানের শোকাবহ ভয়্কংর দিন। সেদিন এদেশের পাকিস্তাানি দোসরদের সহযোগীতায় হানাদার বাহিনীরা পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে উপজেলার তেরটি স্থানে সকাল সাতটা থেকে শুরু করে নির্মম ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। রাউজানের ইতিহাসের সেই নারকীয় গণহত্যায় ১৫৬ জন হিন্দু ও ১০ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়।

 
২০১২ সালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত মামলার অভিযোগের সূত্রে জানা যায়, সেদিন বহু সংখ্যক হানাদার বাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগীতায় সর্বপ্রথম মধ্য গহিরার শীলপাড়ায় গণহত্যা চালায়। এখানে তারা পাঁচ জন হিন্দুকে হত্যা করে।  সেখান থেকে গহিরা হাই স্কুলের পার্শ্ব দিয়ে বিশ্বাস বাড়িতে হামলা করে ৩জন হিন্দুকে হত্যা করে। এরপর মাইল খানেক পূর্বে রাস্তার পাশে বড়পোল পালিত পাড়ায় প্রবেশ করে ৮ জন হিন্দুকে জড়ো করে হত্যা করা হয়।

 

নিজ বাড়িতে স্থাপিত কুণ্ডেশ্বরী মাতৃমন্দিরে প্রার্থনারত অবস্থায় পাকসেনাদের গুলিতে মারা যান অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ। এই দিন পূর্ব গহিরার বৈদ্যবাড়ি ও চৌধুরী বাড়িতে প্রায় ১০০ জন নরনারীকে হাত পা বেধেঁ বেধড়ক মারপিট করে, বাড়ি লুণঠন ও অগ্নি সংযোগ করে॥ রাস্তার পাশে বাড়ই পাড়া গ্রামে ৪ জনকে হত্যা করে। জগৎমল্ল পাড়া ঘেরাও করে অগ্নিসংযোগে নির্বিচারে গুলি করে ৩৬ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। এছাড়া বণিকপাড়ায় ১১ জন, সুলতানপুর ছিটিয়া পাড়ায় ৯ জন, রাউজান পালিতপাড়ায় ১ জনকেহত্যা করা হয়। সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় পাহাড়তলী ইউনিয়নের ঊনসত্তর পাড়ায়।এখানে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই জায়গায় পাক সেনারা চরম তাণ্ডব চালিয়ে ৬৮ জন কে হত্যা করেছিল। একই দিন ইমাম গাজ্জালী কলেজ গেইট সম্মুখে কাপ্তাই সড়কে পাকসেনাদের ব্রাশ ফায়রের শিকার হয়ে ঘটনাস্থলে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তৎমধ্যে ছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র ছাত্র নেতা সাইফুদ্দিন চৌধুরী খালেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সম্পাদক আব্দুর রউফ, কানুনগোপাড়া কলেজের অধ্যাপক দিলিপ চৌধুরী প্রমুখ। এদের মধ্যে একমাত্র জীবিত ছিলেন তৎকালীন ছাত্র নেতা বাশঁখালীর সাবেক এমপি সুলতানুল কবির। সকালে সত্তার ঘাট দিয়ে হানাদার বাহিনীরা প্রবেশ করে উল্লেখিত স্থানগুলোতে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে শহরে যাওয়ার পথে নোয়াপাড়া প্রবেশ করে ৩ জন মুসলমান ও ৯ জন হিন্দুকে হত্যা করে।

 
জানা যায়, সেদিন এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর থেকে রাউজানের ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু ভারতে শরণার্থী হয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হয়। হত্যার এমন নির্মমতা ছিল যে, অনেক পরিবারের মধ্যে কেউই বেঁচে নেই। এদের নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি পাঁচ বছরের শিশু হতে আশি বছরের বৃদ্ধ। নিরপরাধ, নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষগুলোার উপর এমন নৃশংসতা, বর্বরতা যেন হিটলারের বর্বরতাকেও সেদিন হার মেনেছিল।

 

রিপোর্ট :: জয়নাল আবেদীন, রাউজান প্রতিনিধি

 

এ এস / জি এম এম / আর এস পি ::::…….

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!