বোয়ালখালীতে ভাগ্নের বিরুদ্ধে মামীকে ধর্ষণের অভিযোগ, তিন লাখ টাকায় আপস

প্রতিবাদ করায় মা-বাবাকে মারধর

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে মামীকে ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে ভাগিনা স্থানীয় মসজিদের ইমাম আবদুল জলিলের (নিকাহ কাজী) বিরুদ্ধে। গত ১২ এপ্রিল বোয়ালখালী থানায় মামলাটি দায়ের করেন জলিলের আপন মামী। এ ঘটনায় ভাগিনা পলাতক থেকে তার আত্মীয়দের দিয়ে মামলা আপস করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাত্র তিন লাখ টাকায় মীমাংসা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় থানার ওসি সাইরুল ইসলাম।

এদিকে প্রতিবাদ করায় ধর্ষিতার বাবা-মাকে পিটিয়ে আহত করেছে জলিলের আত্মীয়রা। তারা ধর্ষিতাকে আটকে রেখে তার মা-বাবাকে মারধরের এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত শনিবার (২৭ এপ্রিল) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে উপজেলা সদরের কলেজ গেইট এলাকায় একটি আবাসিক বাসায় এ ঘটনা ঘটেছে।

খবর পেয়ে বোয়ালখালী থানা পুলিশ আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে পুলিশ। ধর্ষিতার আহত প্রতিবন্ধী বাবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। স্থানীয় থানার ওসি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, অভিযোগ পেলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৮ সালের ২৬ মে উপজেলার পোপাদিয়া ইউনিয়নের আকুবদণ্ডী গ্রামের প্রবাসী আবু তাহের স্ত্রী-সন্তানের কথা গোপন রেখে বিয়ে করেন পাশের বাড়ির রোজিনা ( ছদ্মনাম) নামের এক কিশোরীকে। বিয়ের পর নববধূকে বোনের ছেলে মাওলানা আবদুল জলিলদের বাড়িতে রেখে এক সপ্তাহ পর বিদেশে পাড়ি জমান আবু তাহের। অভিযোগ রয়েছে মামার অবর্তমানে লম্পট আবদুল জলিলের নজর পড়ে মামীর উপর। এক পর্যায়ে গত বছরের ১০ জুন রাত ১১টার দিকে জলিল জোরপূর্বক ধর্ষন করে মামী রোজিনাকে। এ নিয়ে রোজিনা মুখ খুলতে চেষ্ঠা করলে বাড়ির সবাই আবদুল জলিলের পক্ষ নিয়ে গালমন্দ করতে থাকে এবং এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করলে পরিনাম ভাল হবে না মর্মে হুমকি দেয়। এ সুযোগে পরবর্তিতে বিভিন্ন সময়ে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন করে আসছিল লম্পট জলিল। সর্বশেষ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ধর্ষণ করে বলে দাবি করেন রোজিনা।
বোয়ালখালী থানার উপ-পরিদর্শক (তদন্ত) মো. ওবাইদুল ইসলাম বলেন, মেয়ের মায়ের মুখে এ লোমহর্ষক ঘটনা শুনে গত ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় শ্বশুর বাড়ি থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। পরবর্তীতে মেয়ের স্বীকারোক্তিতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা রুজু করা হয়েছে। আসামি গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার পোপাদিয়া ইউনিয়নের আকুবদণ্ডী গ্রামের শরীয়ত উল্লাহর ছেলে কাজী আবদুল জলিল (৩৫)। তিনি পেশায় পোপাদিয়া ইউনিয়নের নিকাহ্ রেজিষ্টার ও মসজিদের খতিবের দায়িত্ব নিয়োজিত আছেন।

এদিকে মামলাটি মাত্র তিন লাখ টাকায় আপস করছেন ধর্ষিতার এক আত্মীয় ও ধর্ষক জলিলের আরেক আত্মীয়। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় ধর্ষিতার মা বাবাকে মারধর করে রক্তাক্ত করেছে ধর্ষকের আত্মীয়পক্ষের লোকেরা।

হামলায় আহত ধর্ষিতার মা জানান, ধর্ষণ মামলা হওয়ার পর থেকে আসামিরা মামলা তুলে নিতে তাদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। ফলে তার মেয়েকে কয়েকদিনের জন্য বোনের বাসায় নিয়ে যান। কিন্তু তার ছোট বোন মেয়েকে তার কাছে না রেখে পাশের বাড়ির এক মুরগী ব্যবসায়ী আবুল হাশেম প্রকাশ মুরগী বাশীর ঘরে রাখেন। বাশী তাদের কোনো ধরনের আত্মীয় নন। ওইলোকের স্বভাব চরিত্র ভালো না জানতে পেরে বোনের সাথে যোগযোগ করলে বোন মেয়েকে বাবা-মার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাড়িতে খবর দেয়। খবর পেয়ে শনিবার (২৭ এপ্রিল) বিকেলে বোনের ঘরে গেলে বোন তাদের বাশীর বাসায় নিয়ে যায়। তারা মামলাটি দুই লাখ টাকার বিনিময়ে আপস করেছে বলে জানিয়ে একটি কাগজে তাদের সই করতে বলেন। তারা রাজি না হলে ওইখানে বাশী ও এলাকার চিহ্নিত মাদকব্যবসায়ী ইউনুচের নেতৃত্বে ৮-১০ জন দুবৃর্ত্ত তাদের পিটিয়ে আহত করে। এতে তারা স্বামী-স্ত্রী গুরুতর আহত হন। হামলায় তার স্বামীর মাথা ফেটে যায়। তাকে হাসপাতালে আনতে চাইলে দুর্বৃত্তরা ঘরের ভেতর তাদের আটকে রাখেন। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন।

স্থানীয় এলাকাবাসী প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মো. ইউনুচ ও স্ত্রী আনজু বেগম এলাকার চিহিৃত মাদক ব্যবসায়ী। তারা থানা পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে মাদকব্যবসা চালাচ্ছে। তারা মেয়েটিকে নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ মামলাটি আপসের নামে টাকা হাতিয়ে নেয়। মুরগী ব্যবসায়ী আবুল হাশেম বাশী পুরো ঘটনার নেপথ্যনায়ক।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ধর্ষিতার বাবা বলেন, তিনি হতদরিদ্র মানুষ। ভিক্ষবৃত্তি করে পরিবার চালান। আসামি আবদুল জলিল ও তার পরিবার অত্যন্ত প্রভাবশালী। তাদের পক্ষে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতারাসহ প্রভবশালীরা। পরিবার নিয়ে চরম নিরাপত্তহীনতা রয়েছি। ফলে থানা পুলিশ তাদের পাত্তা দিচ্ছেনা। হামলার সাথে জলিলের ইন্ধন রয়েছে দাবি করে তিনি আবদুল জলিলের শাস্তি দাবি করেন।

আপস মীমাংসার সত্যতা স্বীকার করে বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরাও জানতে পেরেছি মামলার বাদি , তার খালা, খালুসহ কয়েকজন মিলে দুই-তিন লাখ টাকার বিনিময়ে ধর্ষণ মামলাটি স্থানীয়ভাবে আপস করেছেন। পরে এ টাকার ভাগ ভাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে পুলিশ আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।’ এ ব্যাপারে তিনি অভিযোগ পেলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন।

গৃহবধুর খালা টাকার নেয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, এক মুরগী ব্যবসায়ীসহ আরও বেশ কয়েকজনের সহায়তায় তিনি দুই লাখ টাকা মামলার আসামি জলিল ও পরিবারের সদস্যরা তার হাতে দেয়। মামলা শেষ হলে আরো এক লাখ টাকা দেবেন বলে জানিয়ে একটি ষ্ট্যাম্পে মামলার বাদির কাছ থেকে স্বাক্ষর নেয়।

উল্লেখ গত ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় নির্যাতীত গৃহবধূর মা আবদুল জলিলের বাড়িতে তার মেয়ের নিযার্তনের ঘটনাটি বোয়ালখালী থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ গৃহবধূকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন। পরে গৃহবধুর স্বীকারোত্তিমুলে ১২ এপ্রিল পুলিশ ধর্ষণ মামলা রজু করেন। মামলা দায়েরের ১৫ দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও পুলিশ এখনো পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!