পাহাড়ি ঢল/ বন্যার পদধ্বনি বৃহত্তর চট্টগ্রামের তিন জেলায়

টানা বৃষ্টি শেষে রোদ হাসতে পারে সোমবারে

বৃহত্তর চট্টগ্রামে গত কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণে ১৪টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর নিম্নাঞ্চলগুলোতেও দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। আগামী দুই দিন শনিবার (১৩ জুলাই) ও রোববার (১৪ জুলাই) পর্যন্ত ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

এর ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এই তিন জেলায় বন্যার আশংকা করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। আসন্ন বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে ত্রাণ বিতরণসহ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. দেলোয়ার হোসেন।

সাতকানিয়ায় পানির নিচে তলিয়ে গেছে সড়ক।
সাতকানিয়ায় পানির নিচে তলিয়ে গেছে সড়ক।

আগামী সোমবার থেকে আবহাওয়া স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছেন আবহাওয়াবিদরা। তবে ভারী বর্ষণের কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজারসহ দেশের আরও কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ভারী বর্ষণের কারণে ১০ জেলায় নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে তিনটি জেলাই বৃহত্তর চট্টগ্রামের। এগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজার। এই তিন জেলায় দেখা দিচ্ছে বন্যার পদধ্বনি।

এর আগে টানা সাত দিনের বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বেড়েছে। ফলে নিম্নাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের বাজালিয়ার বড়দুয়ারা এলাকার রাস্তাটিও তলিয়ে গেছে। অবিরাম বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নদীর পানি প্রবেশ করে শহরের আর্মিপাড়া, ইসলামপুর, অফিসার্স ক্লাব, বনানী সমিল এলাকা, শেরেবাংলা নগর, সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী এলাকাসহ কয়েকটি এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

বান্দরবানে অবিরাম বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নদীর পানি প্রবেশ করে শহরে।
বান্দরবানে অবিরাম বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নদীর পানি প্রবেশ করে শহরে।

আগামী দুই দিন (শনিবার ও রোববার) দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে থেমে থেমে ভারী বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমিধসেরও আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে নদীবন্দরে এক নম্বর নৌ সতর্ক সংকেত জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক সতর্কীকরণ বার্তায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় শুক্রবার (১২ জুলাই) সকাল ১০টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বর্ষণ হতে পারে।

এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ভারী বৃষ্টির কারণে দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, হালদাসহ কয়েকটি নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। প্রবল বৃষ্টির কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলের ৬২৮টি পয়েন্টকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি পয়েন্ট অতি ঝুঁকিপূর্ণ।

পাহাড়ি ঢলে সাঙ্গু নদীর পানি বেড়ে গেছে। বান্দরবানের লামায় পানিবন্দি জীবন।
পাহাড়ি ঢলে সাঙ্গু নদীর পানি বেড়ে গেছে। বান্দরবানের লামায় পানিবন্দি জীবন।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রোগ্রামার তারেক সিদ্দিকী চট্টগ্রাম প্রতিনিদকে জানান, শুক্রবার বিকাল তিনটার তথ্যানুসারে সাঙ্গু নদীর বান্দরবান পয়েন্টে বিপদসীমার ১৪০ সেন্টিমিটার এবং দোহাজারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। সারাদেশের বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৪২৫ নম্বর রুমে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ফোন নম্বর ০২-৯৫৭০০২৮। এই নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সারাদেশে বন্যা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র’-এর টোল ফ্রি ১০৯০ নাম্বারে ফোন করার পর ৫ চেপে বন্যার পূর্বাভাস সংক্রান্ত তথ্য জানা যাবে।

এ দিকে শুক্রবার (১২ জুলাই) বিকাল তিনটা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ২৮ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পতেঙ্গা প্রধান আবহাওয়া অফিস চট্টগ্রাম। হালকা থেকে মাঝারি ধরনের এই বৃষ্টিপাতেই চট্টগ্রাম মহানগরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দেখা দিয়েছে জলজট। নগরীর আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক এলাকা, শান্তিবাগ, ছোটপোল, বেপারি পাড়া, চাক্তাই খালের আশ-পাশের এলাকায় হালিশহর, পতেঙ্গা মাইজপাড়া, ইপিজেডের নিউমোরিং ও আকমল আলী রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় জলজটের সৃষ্টি হয়েছে।

আগামীকাল শনিবার (১৩ জুলাই) সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও পাশ্ববর্তী এলাকার জন্য পতেঙ্গা আবহাওয়ার কার্যালয়ের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আকাশ মেঘলা থেকে অস্থায়ীভাবে মেঘাচ্ছন্ন থাকতে পারে। সে সাথে অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজৃসহ বৃষ্টিপাতের এবং কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এছাড়া বাতাস দক্ষিণ অথবা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে ঘণ্টায় ১২-১৮ কিলোমিটার বেগে যা অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়ার আকারে ৪০-৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

চট্টগ্রাম প্রধান আবহাওয়া কার্যালয় পতেঙ্গার পূর্বাভাস কর্মকর্তা মো. আবদুল হান্নান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগামী দুই দিন রোববার পর্যন্ত ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। আমরা আশা করছি, সোমবার থেকে রোদের দেখা পাওয়া যাবে। আবহাওয়া ভালো হবে।’

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শনিবার ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। সোমবার থেকে আবহাওয়া স্বাভাবিক হতে পারে।’

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রোগ্রামার তারেক সিদ্দিকী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুক্রবার (১২ জুলাই) বিকাল তিনটার তথ্যানুয়ায়ী চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এই তিন জেলায় বন্যার আশংকা করা হচ্ছে।’

চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. দেলোয়ার হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গত কয়েক দিনে চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২ লাখ ৩২ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ৩৮টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং ৯৭৪টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সকল উপজেলার ক্ষতিগ্রস্তদেরকে ইতিমধ্যে তিন লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আমাদের হাতে নগদ ১০ লাখ টাকা এবং ১৬৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ আছে। রাউজান, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে তিন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের ওষুধ, পানিসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতিতে মোকাবেলায় জেলা পর্যায়ে ০৩১-৬১১৩৪৫ এবং ০১৭০০-৭১৬৬৯১ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!