পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা/ রাঙ্গুনিয়ায় নয় বছরে ১৫০ পাহাড় কেটে সাবাড়

পাহাড় কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও দণ্ডণীয় অপরাধ হলেও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৫ ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় গত নয় বছরে কাটা হয়েছে ১৫০টি পাহাড়। পাহাড়গুলো কাটার কারণে পাশের অন্যান্য পাহাড়ে সৃষ্টি হচ্ছে ফাটল। ফাটলধরা এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ধসে ঘটছে দুর্ঘটনা। এছাড়া বৃষ্টির পানির সঙ্গে এসব পাহাড় থেকে মাটি পড়ে ভরাট হচ্ছে সড়ক ও ফসলি জমি। পাহাড় কাটার কারণে রাঙ্গুনিয়ায় দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা।

এলাকাবাসী জানান, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার সংরক্ষিত বন ও ভূমি অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন পাহাড় কাটা শুরু করেন। গত নয় বছর ধরে রাঙ্গুনিয়ার কোথাও না কোথাও পাহাড় কাটা চলছে। কখনো ভিটেবাড়ি, কখনো ডোবা ভরাট করে ভিটে তৈরির মাটি সংগ্রহে এসব পাহাড় কাটা হয়। যাদের ভিটেবাড়ি বা ডোবা ভরাট করা হয় পাহাড় কাটার সাথে তাদের তেমন সম্পৃক্ততা নেই। এসব পাহাড়কাটার সাথে যুক্ত স্থানীয় প্রভাবশালী সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। তাদের কাছ থেকে ভিটে বা ডোবার মালিকরা এসব মাটি কিনে নেন। এছাড়া নির্বিচারে পাহাড় কেটে ইটভাটায় মাটি সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া এসব পাহাড়ের মাটি যাচ্ছে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পেও। স্কুল মাঠ ভরাট, সড়ক নির্মাণ, পুকুর নদী বা খালের পাড় ভরাট ইত্যাদি কাজে পাহাড়ের মাটিই একমাত্র ভরসা। এসব পাহাড়ের যেন কোন মালিক নেই। বন বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সবাই রয়েছে গভীরঘুমে।

উত্তর রাঙ্গুনিয়ার ৭ ইউনিয়ন রাজানগর, দক্ষিণ রাজানগর, ইসলামপুর, হোছনাবাদ, লালানগর, পারুয়া ও স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটে। রাজানগর, দক্ষিণ রাজানগর, ইসলামপুর এই তিন ইউনিয়নে রয়েছে শতাধিক ইটভাটা। এসব ইটভাটায় মাটি সরবরাহের জন্যে এ ৭ ইউনিয়নের পাহাড় নির্বিচারে সাবাড় করা হচ্ছে। এছাড়া সরফভাটা, বেতাগী, পোমরা ইউনিয়নের পাহাড়গুলোরও রেহাই মিলছে না। পোমরা ও বেতাগী ইউনিয়নের পাহাড়গুলোতে কালো থাবা পড়েছে ওয়াসা কেন্দ্রীক সিন্ডেকেটের।

গত ১৪ সাল থেকে উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের শান্তিরহাট এলাকায় ওয়াসার পানি শোধানাধার প্রকল্পের মাটি ভরাটের জন্যে এই দুই ইউনিয়নের পাহাড়গুলোকে নির্বিচারে কাটা হয়েছে। বর্তমানে উত্তর রাঙ্গুনিয়ার কমপক্ষে ১০টি স্থানে পাহাড় কাটা চলছে। এসব পাহাড় কাটার পেছনে রয়েছেন সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। অথচ তাদের ব্যাপারে কেউ মুখ খোলে না। কতিপয় স্থানীয় প্রভাবশালী সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা চুক্তিতে পুকুর, ডোবা, দিঘি ও নিচু জমি পাহাড়ের মাটি দিয়ে ভরাট করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে জানা যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় প্রভাবশালী নেতা-কর্মী পাহাড়গুলো কেটে সাবাড় করছেন। পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার বিষয়টিও তাঁরা আমলে নিচ্ছেন না। বৃষ্টির কারণে পাহাড়গুলোতে এখন বড় বড় ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। ধসেও পড়েছে কয়েকটি।

এদিকে বছরের পর বছর ধরে নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। মরা পড়ছে নিরীহ মানুষ। প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে মানুষ মরার ঘটনা ঘটছে। গত ২০১৭ সালের ১৩ জুন মঙ্গলবার দিবাগত রাতে উপজেলার রাজানগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের দুই পরিবারের ২২ সদস্যের পাহাড় ধসে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ৫ জায়গায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর এলাকায় পাহাড় কাটার মাটি চাপা পড়ে এক শিশুসহ ৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বছরের পর বছর পাহাড়ে বসতি, পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল উজাড়ের মতো প্রকৃতি ধবংসের প্রতিযোগিতা চললেও এসব থামাতে কারোই যেন গরজ নেই। দুর্ঘটনায় প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসলেও দু’দিনের মাথায় তা থেমে যায়।

পাহাড় কাটার দায়ে বন বিভাগ মামলা করলেও সেখানে পরিচিত ব্যক্তিদের নাম মোটেই আসে না। যাদের নাম আসে তাদের পুলিশ খুঁজে পায় না।

রাঙ্গুনিয়া সাবেক চেয়ারম্যান ও রাঙ্গুনিয়া উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মো. আলীশাহ বলেন, ইছাখালী এলাকায় কাটা পাহাড়ধসে বৃষ্টির সঙ্গে মাটি চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে নেমে এসেছে। ফলে যান চলাচল বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমিও। তিনি আরও বলেন, পাহাড় কেটে সাবাড় করলেও উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। পাহাড় কাটায় জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে আঁতাত থাকায় পুলিশ প্রশাসনও নীরব রয়েছে। তবে র‌্যাব সদস্যরা দুবার অভিযান চালিয়ে মাটি কাটায় জড়িত শ্রমিকদের আটক করে কারাগারে পাঠালেও কিছুদিন পর জমিনে এসে পুনরায় পাহাড় কাটা শুরু করেন।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাকসুদুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাহাড় কাটার সময় অভিযান চালিয়ে কয়েকজন শ্রমিক ও উপকরণ আটক করা হয়েছে। পাহাড় কাটারোধে উপজেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

রাঙ্গুনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমতিয়াজ আহসান ভূঁইয়া বলেন, ‘পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব বন বিভাগ ও ভূমি প্রশাসনের। কোনো রকম মামলা ছাড়া পুলিশ পাহাড় কাটায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে?’

রাঙ্গুনিয়া ইছামতি রেঞ্জ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পাহাড় কাটার বিষয়ে বন বিভাগ নীরব রয়েছে, তা ঠিক নয়। গত নয় বছরে বন বিভাগ পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!