ট্রাজেডির অপেক্ষা/ রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে ৭ হাজার পরিবার

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে প্রায় সাত হাজার পরিবার। এসব পরিবার পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতঘর গড়ে তুলেছে। প্রতিবছর বর্ষায় অনেক বসতঘর পাহাড়ের মাটি ধসে চাপা পড়ে যায়। ঘটে হতাহতের ঘটনাও। কিন্তু তারপরও পাহাড়ে থেমে নেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৫ ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় নয় হাজার একর সরকারি ও ১৫ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে। এসব এলাকায় প্রায় সাত হাজার বসতঘর রয়েছে।

চন্দ্রঘোনার বনগ্রামের বার মহল্লা সর্দার আবু মনছুর জানান, বনগ্রাম এলাকার শতাধিক পাহাড় কেটে অবৈধভাবে বসতঘর নির্মাণ করে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে প্রায় দেড় হাজার পরিবার। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় এসব বসতঘর নির্মাণের সুযোগ করে দেন। বিগত ২০১১ সালের ২৭ জুন টানা বর্ষণে বনগ্রামের ছয়টি স্থানে পাহাড় ধসে ১০টি বসতঘর মাটি চাপা পড়ে।

chittagong-rangunia-hill-cutting
পাহাড়ে থেমে নেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস।

পারুয়া ইউপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুল ছত্তার বলেন, ‘জঙ্গল পারুয়া গ্রামের পাহাড়ে প্রায় ৬০০ পরিবার বসবাস করছে। এই বর্ষায় তারা পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে জঙ্গল পারুয়া গ্রামে আবুল খায়ের নামে এক ব্যক্তি নিহত হন।’

পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম জানান, ইছাখালি, গুচ্ছগ্রাম, জাকিরাবাদ, কাদের নগর ও নোয়াগাঁও পৌর এলাকায় পাহাড়ে বসবাস করছে প্রায় ৮০০ পরিবার। এদের অনেকে পাহাড়ের চূড়া কেটে বসতঘর তৈরি করে বসবাস করছে। গত ২০১৮ সালে দিনের টানা বর্ষণে এসব এলাকার ছয়-সাতটি স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে গুচ্ছগ্রামে ৪ টি বসতঘর মাটি চাপা পড়ে।

এদিকে ইছাখালী মোহাম্মদপুর পৌর এলাকার পাহাড়ে বসতঘর নির্মাণ করে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে অর্ধশতাধিক পরিবার। সেখানকার বাসিন্দা আয়েশা খাতুন (৫০) জানান, মরিয়মনগর ইউনিয়নের বালুগোট্টা গ্রামে কর্ণফুলী নদীতে ভিটেবাড়ি হারিয়ে ২০০৯ সালে এ পাহাড়ে বসতঘর নির্মাণ করেন তিনি। কিন্তু গত ২০১১ সালের বর্ষায় পাহাড়ের মাটি ধসে বসতঘরের নিচে চাপা পড়ে তার চার বছরের শিশু আবদুল কাদেরের কোমর ভেঙে যায়।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ১৩ জুন মঙ্গলবার দিবাগত রাতে পাহাড় ধসে উপজেলার রাজানগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের দুই পরিবারের ২২ সদস্যের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এছাড়াও পাঁচ জায়গায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর এলাকায় পাহাড় কাটার মাটি চাপা পড়ে এক শিশুসহ তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের কমিউনিটি সেন্টার, জঙ্গল বেতাগী এলাকায় পাহাড় কেটে প্রভাবশালীরা মাটি বিক্রি করছে। একইভাবে উপজেলার উত্তর রাঙ্গুনিয়ার ১ নং রাজানগর, ১৩ নং দক্ষিণ রাজানগরের মুহাম্মদপুর, বাইশ্যাের ডেবা, ১৪ নং ইসলামপুরের মঘাছড়ি, রইস্যার, ১৫ নং লালানগরের চাঁদের টিলা, ছনখোলা বিল,পেইট্ট্যাঘোনা, আগুনিয়া চা বাগান, হোসনাবাদ ইউনিয়নের নিশ্চিন্তাপুর, ফকিরারটিলা, ফুইট্ট্যােগোদা , পোমরা, কোদালা, পোমরা, পারুয়া, সরফভাটা, শিলক ও পদুয়া ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় কেটে বসতঘর তৈরি করে বসবাস করে আসছে চার হাজারেরও বেশি পরিবার।

এ প্রসঙ্গে বনবিভাগের রাঙ্গুনিয়া ইছামতি রেঞ্জ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীরা কোনো আইন মানে না। তাদের উচ্ছেদ করার পরও আবার বসতি গড়ে।’

এ প্রসঙ্গে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশ কেটে বসতঘর নির্মাণ না করার জন্য রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাইকিংসহ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। তাতেও পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন বন্ধ হয়নি। পাহাড়ে বসবাসকারী এতগুলো পরিবারকে পুনর্বাসন করাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ অবস্থায় পাহাড়ধসের হাত থেকে বসবাসকারীদের বাঁচানোর ব্যাপারে প্রশাসন খুবই উদ্বিগ্ন। তবে পাহাড়ধসে হতাহতের ঘটনা এড়ানোর জন্য সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!