ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বারক কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় শতবছর ছুঁই ছুঁই দেশের বৃহৎ এ মাটির ভবন

সৈয়দ আসাদুজ্জামান লিমন :
বহু ইতিহাস ও ঐহিত্যের স্বারক হিসেবে এখনো ঠাঁই দাড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়টি। বর্তমান যুগে ছোট্ট একটি পানের দোকান থেকে শুরু করে যেখানে ইট পাথরের গাঁথুনি ছাড়া চিন্তা করা যায় না সেখানে শতবছর ছুঁই ছুঁই বিদ্যাপীঠটির মৃৎ শিল্পের উপরেই এখনো বিদ্যমান। বিদ্যালয়টির সাফল্যের পালকে রয়েছে অনেক অর্জন। এটি উপজেলার Kadhurkhil Schoolঅন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে বিদ্যালয় প্রতিষ্টাতা প্রধান শিক্ষক স্বর্গীয় বিধুভুষণ চৌধুরীর নের্তৃত্বে স্থাপিত হয় কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়। মাটির তৈরী অন্যতম এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মৃৎশিল্পের উপরেই প্রথম নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯১৮ সালে। শেষ হয় ১৯২০ সালে । সে থেকে ক্রমান্বয়ে বিদ্যালয়টির সম্মূখভাগের মূল কক্ষের পেছনে শ্রেনী কক্ষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মৃৎ শিল্পের উপরই চলে সকল নির্মাণশৈলী।

বৃক্ষরোপনে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত এই বিদ্যালয় ঘেঁষে রয়েছে বিরাট পার্বতী চরণ দীঘি। কৃতিত্বস্বরূপ ২০০৯  সালে স্কুলপর্যায়ে বৃক্ষরোপণে প্রথম হয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে বিদ্যালয়টি। দীঘির চারদিকে শোভাহিত সারিবদ্ধ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, প্রাকৃতিক আবহাওয়া আর মনোরম পরিবেশে ছাত্র-ছাত্রীরা স্বাচ্ছন্দে পাঠদানে আগ্রহী হয়। প্রতিদিন বিকেলে শান বাঁধানো ঘাটে দিঘির স্বচ্ছ পানিতে মাছের খেলা দেখতে এলাকাবাসী ছাড়া ছুটে আসে বাইরের অনেকে। প্রতিবছর শীতে অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয় বিদ্যালয় অঙ্গন ও সংলগ্ন দিঘি। বিদ্যালয়ের সামনে অথাৎ মূল গেইট ডিসি সড়কের সাথে যুক্ত এবং পাশে রয়েছে বোয়ালখালী ষ্টেডিয়াম।

শত বছর ছুঁই ছুঁই এ বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ২০৩ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৫ ফুট প্রস্থের এ ভবন নির্মাণে মাটি ছাড়া ব্যবহার করা হয়েছে টিন, গাছ, বাঁশ ইত্যাদি। মিয়ানমারের (তৎকালীন বার্মা) রাজধানী ইয়াংগুন (রেঙ্গুন) থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে বাঁশ ও গাছ। দীর্ঘ সময় নিয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হয় ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে। কালের বিবর্তনে এতে যুক্ত হয়েছে পাকা-আধাপাকা আরো কয়েকটি ভবন। তবে মূল ফটক পেরিয়ে বিদ্যালয় আঙিনায় প্রবেশ করলে মাটির তৈরি আকর্ষণীয় ভবনটি দেখে যে কেউ একবারের জন্য হলেও থমকে যেতে বাধ্য।

আলী আহমদ কমিশনার সড়কের উপর দিয়ে চলাচল করার সময় দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর গৌরবময় কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়টি। জাতির গৌরবময় মহান মাতৃভাষা সংগ্রামের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে এ বিদ্যালয় ভবনের পাশে নির্মিত শহীদ মিনারটি। ১৯৬২ সালে এখানকার শিক্ষার্থীরা নির্মাণ করে দেশের স্কুলপর্যায়ে প্রথম এ শহীদ মিনারটি।

২০১৩ সালের ২০ আগস্ট বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ সভাপতি আলহাজ্ব মঈন উদ্দীন খান বাদল এমপি’র ঐKadurkhil High Schoolকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশের বরেণ্য স্থাপত্যবিদ ড. মোবাশ্বের আলীর নেতৃত্বে একটি টিম ঐ বছর ২২ আগস্ট কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়েল মাটির ঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় ড. মোবাশ্বের আলীসহ বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসা আগত স্থপতিরা বিদ্যালয় সম্মেলন কক্ষে শিক্ষার্থীদের সাথে মত বিনিময় করেন। বলা হয়, মাটির তৈরি স্থাপত্যকলায় ভরপুর এত বড় ভবন দেশের আর কোথাও নেই। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হলে এটি জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিলা আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে একটি নিরীক্ষা দল বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসেন। পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়ের নির্মাণশৈলী, স্থাপত্যকৌশল, স্থানীয় লোকজ শিল্পমান রক্ষার বর্ণনাসহ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠান প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক শিরিন আকতার। কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের মাটির ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ, সংস্কার, উন্নয়ন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। পরে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১ আগস্ট প্রধান শিক্ষকের হাতে বিদ্যালয়ের ‘মৃত্ভবন’ প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের তালিকায় নেওয়ার সনদ তুলে দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন।

প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর তাদের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেনকে কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের মৃত্ভবন রক্ষণাবেক্ষণ, তদারকি ও উন্নয়নের সার্বিক দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে। ইতিমধ্যে সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের মৃৎ ভবনের সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ বড়ুয়া। শতবর্ষী এ বিদ্যালয়কে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিভিন্ন আর্কিটেকচারদের মাধ্যমে এ স্থাপনার আধুনিক সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এই মৃৎ ভবনটি ২০০/২৫০ বছর পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে দেশের স্থাপত্যবিদদের ধারণা।

 

এ এস / জি এম এম / আর এস পি ::: 

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!