জয়নাল আবেদীন, রাউজান (চট্টগ্রাম) :
এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। হালদার পোনা দ্বারা দেশের মৎস চাহিদার সিংহ ভাগ পুরণ করে থাকে। তাই বলা হয় “হালদার পোনা দেশের সোনা”। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখা এই হালদা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ঊঠেছে বেশ কয়েকটি ইটখোলা।
প্রভাবশালী মহল কতৃক নদী দখল ও ভরাট করে গড়ে তোলা এসব ইট খোলার কারণে নদীর গভীরতা হ্রাস, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, নদী দূষণ, বাঁক কেটে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ঘটছে। যার দরুণ হালদা নদীর ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের পথে। কমে যাচ্ছে মাছের প্রজনন, বাড়ছে নদী ভাঙ্গন। একদিকে রুদ্ধ হচ্ছে মৎসজীবিদের আয়ের পথ। অন্যদিকে হালদা পাড়ের বাসিন্ধাদের পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি বিজরিত বসতভিটা, ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি, উপসনালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত হালদার বুকে বিলিন হচ্ছে ।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, রাউজান উপজেলার উরকির চর ইউনিয়নের হাড়পাড়া নামক স্থানে হালদার পাড় দখলে নিয়ে গড়ে উঠেছে আজমীর অটোব্রিক ফিল্ড নামের একটি ইটভাটা। এর পাশে রয়েছে এ আলী ব্রিকফিল্ড। তার অপর তীরে চাঁন্দগাঁও থানাধিন মোহরা নামক এলাকায় রয়েছে কে.পি.এম ব্রিকফিল্ডসহ কয়েকটি ব্রিক ফিল্ড। নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে তোলা এসব ব্রিক ফিল্ডে নদী দখল অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে মাটি উত্তোলন করে নদী ভরাট করছে। এসকল ইটখোলার নদী দখল ও অপরিকল্পিতভাবে নদীর বাঁক কেটে মাটি উত্তোলনের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে হালদা রাক্ষুসে রূপ ধারণ করায় নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মোকামী পাড়া গ্রামটি বিলুপ্তির পথে।
মোকামী পাড়া গ্রামের হালদা পাড়ের বাসিন্ধা রাউজান প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস. এম ইউসুফ উদ্দিন জানান, উরকিরচর ও মোহরার অংশে হালদার উভয় পাড়ে গড়ে ওঠা ইটখোলা সংলগ্ন নদী দখল ও মাটি উত্তোলনের ফলে নদী গতিপথ পরিবর্তন হয়ে পানির স্রোত সরাসরি আঘাতে আনছে মোকামী পাড়া গ্রামে। তাই প্রতিনিয়ত হালদায় ভাঙ্গনে ছোট হয়ে এসেছে বাপ-দাদার স্মৃতি বিজড়িত গ্রামটি। হালদার তীব্র থেকে তীব্রতর ভাঙ্গনে প্রতিটি মুহুর্ত আতঙ্কে কাটাচ্ছে এই হালদার পাড়ের বাসিন্ধারা।
নদী দখল ও দূষণের বিষয়ে আজমীর অটোব্রিক ফিল্ডের মালিক ফরহাদ বলেন, এই ইটখোলা সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব এবং আমাদের নিজস্ব জায়গায় বসানো হয়েছে। তবে তিনি দখলের কথা স্বীকার করে বলেন, হালদার পাড়ের অংশটি সরকারী জায়গা। সরকার চাইলে দখল ছেড়ে দেওয়া হবে। আর মাটি ভরাটের ফলে অন্য অংশে ভাঙ্গলেও ইটখোলার অংশে নদী ভাঙন রোধ পেয়েছে। তিনি থেকে মাটি উত্তোলনের কথা অস্বীকার করলেও হালদার পাড় দখল করে মজুদ রাখা মাটির স্তুপের উৎসের সঠিক তথ্য দিতে পারেনি পরিদর্শনরত সাংবাদিকদের।
ইটখোলার বিষয়ে হালদা রক্ষায় অন্দোলনরত নেতৃবৃন্দরা জানান, ইটখোলা হালদার জন্য হুমকি স্বরূপ। হালদার পাড়ে ইটখোলার গড়ে তোলায় নদী দূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও নানা কারণে মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর প্রভাবে মা-মাছের ডিম হ্রাস পাচ্ছে বলেও জানান তারা। তাই,হালদার পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো অন্যত্রে সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন বলে মনে করেন। সেই সাথে হালদা নদীর ভাঙ্গন ও দূষণের দায়ীদের বিরোদ্ধে প্রসাশনের নীরব ভুমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
ইতোমধ্যে, এটি পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী (যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে এবং নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়) হালদাকে দূষণের কবল থেকে রক্ষায় অন্দোলনে ডাক দিয়েছে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। এসব সংগঠন সাম্প্রতি রাউজান, হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করেছেন। তাদের অভিমত, হালদা নদী প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য।
এই হালদা নদীর ৪টি বাঁক কেটে ফেলা, অপরিকল্পিতভাবে সুইচগেট নির্মাণ, মা-মাছ নিধন, হালদা সংলগ্ন এলাকায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে ইটখোলা,শিল্প-কারখানা গড়ে উঠাই এ নদীতে মাছের প্রজনন কমে যাচ্ছে। জানা যায়, হালদায় এবার ১৯ -২১ মে জো’র সময়ে রাউজান, হাটহাজারী উপজেলায় প্রায় ৩০-৩৫ পয়েন্টে শতাধিক নৌকা নিয়ে মৎসজীবিরা ডিম সংগ্রহে দিন-রাত অধীর অপেক্ষায় নদীর সাথে মিতালী গড়ে তুললেও আশানুরূপ ডিম সংগ্রহ করতে পারেন নি। ব্যাপক হারে ডিম হ্রাস পাওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে মৎসজীবিদের মাঝে।
ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী বিশ্ব প্রকৃতিক ঐতিহ্যের যোগ্যতা সম্পন্ন হালদা নদীর ভাঙ্গন রোধ, দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে না পারলে হালদা নদীর ঐতিহ্যের বিলুপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই হালদা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট প্রসাশনের যথাযত ভুমিকার পাশাপাশি স্থানীয়দের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন পরিবেশবাদী কর্মীরা।
এ এস / জি এম এম / আর এস পি :::