বায়েজিদে তরুণী খুনের পর থানার অদূরে ফ্ল্যাটে অনৈতিক কার্যকলাপের কথা জানলো পুলিশ!

বায়েজিদের মৃধাপাড়ায় ১৩ মে রাতে মনির গলিত লাশ উদ্ধারের পর তদন্তে বেরিয়ে আসে ওই ফ্ল্যাটে মনিসহ চার নারীকে রেখে দেহব্যবসা পরিচালনা করতো একটি চক্র। আমিন জুটমিলের একপাশে বায়েজিদ থানা অপরপাশেই মৃধাপাড়া। থানার পাশেই চলছিলো এসব অনৈতিক কাজ। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা স্বীকার করলেন থানা যদি সতর্ক থাকতো তবে অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়ানো যেতো!

সরেজমিনে মৃধাপাড়ায় গিয়ে জানা যায়, সৌদি প্রবাসী জামালের গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়ায়। তিনি বিয়ে করেছিলেন নগরীরর বায়েজিদের মৃধাপাড়ার আকবর হোসেনের মেয়েকে। শ্বশুর বাড়ির কাছেই তিনি চারতলা বাড়ি তৈরি করেছেন। বাড়িটি এলাকার মানুষ আকবর ভবন নামেই বাড়িটি চিনে। বাড়ির মালিক জামালের অনুপস্থিতিতে তার শ্যালক রুবেল বাড়ির দেশাশোনা করতেন। ছয় মাস আগে ওই বাড়ির চতুর্থ তলার দুই কক্ষের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন আবদুল হালিম। স্ত্রী, শ্যালিকা ও ভাগনি পরিচয়ে সঙ্গে তিন নারী নিয়ে বাসায় ওঠেন। পুতুল স্ত্রী, নিহত মনি শ্যালিকা আর নাসরিন আক্তার লাবণ্যকে ভাগনি পরিচয় দেয়। প্রকৃতপক্ষে তিনজনকে দিয়েই হালিম দেহব্যবসা পরিচালনা করতেন। এই তিনজনের সঙ্গে মাঝে মাঝে যুক্ত হতো তানিয়া। খদ্দেররা আকবর ভবনেও আসতো, আবার এই চার জন বাইরেও যেতো।

মামলার তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ভাসমান এই দেহকর্মীদের আয়ে ভাগ বসাতো হালিম। ভাগবাটোয়ারায় না মেলায় তানিয়া দল ছেড়ে চলে যায় চারমাস আগে। তার পথ ধরে পুতুলও চলে চায় একমাস পর। মনি খুন হওয়ার মাসখানেক আগে চলে যায় লাবণ্যও। তবে মনির যাওয়ার আর জায়গা ছিল না। মনি তার আয়ের সবটুকুই বিশ্বাস করে জমা রেখেছিল হালিমের কাছে। জমেছিল দেড় লাখটাকারও বেশী। মনির বোনের বিয়ে উপলক্ষে হালিমের কাছে টাকা ফেরৎ চেয়েছিল।

মনি হত্যা মামলায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে খুনী নিজাম। স্বাক্ষ্য দিয়েছেন লাবণ্য,পুতুল আর রুবেল। পুলিশ জানিয়েছে হত্যার নির্দেশদাতা আবদুল হালিমকে গ্রেপ্তার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।


যেভাবে মিললো অনৈতিক কাজের আস্তানা

মনিকে খুন করে খুনের নির্দেশদাতা হালিমকে নিশ্চিত করেছিল খুনী নিজাম। নিজাম ঘটনাস্থল ত্যাগের পর হালিমের নির্দেশে বাড়ির কেয়ারটেকার রুবেল গিয়ে মনির লাশ দেখে হালিমকে মৃত্যুর ঘটনা নিশ্চিত করে। হালিম আর নিজাম গা ঢাকা দিলেও স্বাভাবিক ছিল রুবেল। সন্দেহজনক দূর্গন্ধ পাচ্ছে বলে জানিয়ে রুবেল ১৩ মে গভীর রাতে বায়েজিদ থানা পুলিশকে খবর দেয়। থানা পুলিশের টিম গিয়ে সরেজমিনে দেখলেন। জানালো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। ছুটে গেলেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার, উপ কমিশনারসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ।

লাশের পরিচয় মিলেছে পরে,দাফন হলো অজ্ঞাত হিসেবেই

মনির মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করে তিনদিনের মাথায় নগরীর ডবলমুরিং থানার মুহুরীপাড়া থেকে আটক করা হলো নিজামকে। নিজাম রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরের বাইশ্যার বাপের বাড়ির মৃত জালাল আহাম্মদের ছেলে। নিজাম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। অপর দিকে পুলিশ খুঁজে পেয়েছে নিহত মনির পরিবারকেও। মনি চকরিয়ার বদরুদ্দোজার মেয়ে। কিন্তু ততদিনে মনির ঠিকানা হয়েছে অজ্ঞাত লাশ হিসেবে নগরীর বাইশমহল্লা কবরস্থানে।

নিজামের জবানিতে খুনের বর্ণনা

১০ মে রাতে হালিম নিজামকে নির্দেশ দেয়, মনি বাড়াবাড়ি করছে। যেকোন সময় বিপদ হতে পারে। তাকে সরিয়ে দে। হালিমের কথা মতো নিজাম ১১ মে সকাল দশটার পর বায়েজিদ থানাধীন মৃধাপাড়ার জামালের বাড়ির সামনে গিয়ে মনিকে ফোন করে। মনি উপরে যেতে বললে নিজাম যায়। এ সময় নিজামকে চা-নাস্তা দেয় মনি। চা নাস্তা শেষে মনি ভিতরের রুমে গিয়ে প্রস্তুতি নেয় সহবাসের। নিজাম ভিতরের রুমে গিয়ে তাকে বোঝায় হালিমের কথা মতো চলতে। মনি তর্ক শুরু করলে নিজাম তাকে দুটো চড় দেয়। নিজামের চড়ের আঘাতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মনি দেয়ালের উপর পড়ে যায়। তার কান, নাক আর মুখ দিয়ে রক্ত গড়াতে শুরু হয়।মনি চিৎকার দিলে প্রথমে দুহাতে গলা টিপে ধরে পরে গলায় গামছা চেপে ধরে নিজাম। মনির শরীর ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মৃত্যু নিশ্চিত করে হালিমকে ফোনে জানিয়ে নিজাম চলে যায়।

রুবেলকে দিয়ে হালিম মনির মৃত্যুর খবর যাচাই করে

হালিম মনির মৃত্যুর বিষয়টি রুবেলকে চেক করতে বলে। রুবেল ১১ তারিখ বিকেলে বাসায় ঢুকে মনির মৃতদেহ দেখে হালিমকে জানায়। মনির মৃত্যুর বিষয়টি হালিম-নিজামের পর রুবেল জেনেও পুলিশের কাছে পুরোপুরি আড়াল করার চেষ্টা করে। রুবেলের কাছে মনির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে সুযোগ বুঝে হালিম ওই বাসায় আসে। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ওই বাসা থেকে সরিয়ে নেয়।

যেভাবে খুনের ঘটনায় জড়ালো রুবেল

নিজের ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ করে দেয়ার আগে হালিম তানিয়াকে জানায় নিজাম মনিকে খুন করেছে। তানিয়া পাল্টা প্রশ্ন করে হালিমকে, ‘কীভাবে জানলেন?’ হালিম তানিয়াকে জানায় নিজাম মেরে চলে যাওয়ার পর রুবেল গিয়ে দেখে এসেছে। তানিয়া রুবেলকে ফোন করলে রুবেল তাকে যা দেখেছে তার বিবরণ দেয়।

বায়েজিদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) প্রিটন সরকার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ১৩ মে দিবাগত রাতে খবর পেয়ে আমরা মনির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করি। তদন্তের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে লাশ অজ্ঞাত হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করি। মনির লাশ নগরীর বাইশ মহল্লায় দাফন করা হয়েছে। তদন্তের পরে আমরা মনির পরিচয় সনাক্ত করতে পেরেছি। তার বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়ায়। ইতোমধ্যে তার পরিবারের লোকজন এসে যোগাযোগ করেছেন।

নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক বলেন, এলাকাটা থানার কাছে হলেও যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো নয়। তবে পুলিশের টহল নিয়মিত থাকলে এবং সতর্ক থাকলে অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়ানো যেতো। আবার বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়ার তথ্য থানায় নিয়মিত আপডেট রাখলে থানার পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া সহজ হতো।

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!