বলিরহাটে জোড়ামৃত্যু/ প্রতিবেশী পাশাপাশি, মাদক এসে মাঝখানে এঁকে দিল দূরত্ব

চট্টগ্রামের বাকলিয়ার বজ্রঘোনার মদানী জামে মসজিদ। পশ্চিম পাশে বুবলীর বাড়ি আর পূর্ব পাশে শাহ আলমের বাড়ি। মসজিদের সঙ্গে লাগোয়া পাড়ার কবরস্থান। একই কবরস্থানে শায়িত দুজনেরই পূর্বপুরুষ। একই মসজিদেই তারাবির নামাজ আদায় করছিলেন দুই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। কিন্তু এত কিছুতেও এক রাখতে পারেনি পাশাপাশি বাড়ির দুই প্রতিবেশীকে সেই সর্বনাশা মাদক। ওই কবরস্থানে কবর তৈরি হয়েছে বুবলির জন্য, কিন্তু শাহ আলমের লাশটা গ্রহণ করার কেউ নেই!

মাদকের স্পর্শ বদলে দিল নকশামিস্ত্রীর জীবন

bolirhat-murder
নানার সঙ্গে বুবলির দুই শিশুকন্যা উষমি ও রেশমি
প্রতিবেশী আজাদ হোসেনের মুখ থেকে জানা গেল ঘটনার পূর্বাপর। মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করতে গিয়ে গত বছর ৬ রমজান শাহ আলমের ছুরিকাঘাতে মারাত্মক আহত হন রুবেলের বন্ধু হাসান। হাসানকে চিকিৎসা দিতে রুবেল মেডিকেল নিয়ে যান। ছুরিকাঘাতের ঘটনায় শাহ আলম গ্রেফতার হয়ে কারাগার থেকে কিছু দিন আগে ছাড়া পান। ছাড়া পেয়েই আগের মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিতে সক্রিয় হন শাহ আলম। তার ধারণা ছিল ছুরিকাঘাতে হাসান মারা যাবে। কিন্তু রুবেলের তৎপরতায় হাসান বেঁচে যাওয়ার খবর পায় শাহ আলম। এতেই শাহ আলম ক্ষিপ্ত হন রুবেলের ওপর।
১১ মে রাতে রুবেলকে খুঁজতে যান শাহ আলম। ঘরের সামনে রান্নাঘর। রান্নাঘর লাগোয়া বেসিনে বুবলি হাঁড়িপাতিল পরিষ্কার করছিলেন। উদ্ধত পিস্তল নিয়ে শাহ আলম রুবেলের সন্ধান চাইলে বুবলির সাথে তর্ক হয়। প্রথমে বুবলির মুখে নল ঠেকিয়ে গুলি করে শাহ আলম। বুবলি লুটিয়ে পড়লে বুকে আরেকবার গুলি করে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে নিরাপদ আস্তানায় চলে যায়।

প্রতিবেশীরা জানান, শাহ আলম পেশায় একজন নকশামিস্ত্রী ছিলেন। মাদকের স্পর্শে বদলে যায় তার জীবন।

তিন বছরের রেশমির প্রশ্ন ‘মাম্মাম কই?’

bolirhat-murder
রুবেলের তৎপরতায় হাসান বেঁচে যাওয়ার খবর পায় শাহ আলম। এতেই শাহ আলম ক্ষিপ্ত হন রুবেলের ওপর।
বুবলির ঘরের সামনে জটলা। জটলা ঠেলে এগিয়ে যেতেই দেখা যায় উষমি ও রেশমি নামের দুই কন্যা শিশু। উষমির বয়স পাঁচ আর রেশমির তিন। চঞ্চল রেশমি একে ওকে ধরে জিজ্ঞেস করছে মাম্মাম কই? উষমিও খুঁজছিল। দুপুর থেকে তার খোঁজা বন্ধ। দরজায় লেপ্টে থাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা হয়েছে বোঝার চেষ্টা হয়তো করছে উষমি।

বুবলির মা বার বার মুর্চ্ছা যাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন, ও খোদা, আমার বুক কেন খালি করলা? আমাকে না নিয়ে আমার কলিজার টুকরা কেন নিলা?
বুবলির বোন চুমকি আক্তার এগিয়ে এসে মেহেদি রাঙা হাত দেখিয়ে বললেন, ৫ মে আমার বিয়ে হয়েছে। আপু আজ আমাকে বিদায় দিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই আপু দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।

ছোট ভাই রুবেল চোখ মুছতে মুছতে বললেন, হাসানের আহত হওয়ার ঘটনা থেকে শাহ আলম ক্ষিপ্ত ছিল। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমার কাছে চাঁদা দাবি করছিল। পাশাপাশি তার মাদক ব্যবসা নিয়ে আমরাসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে বিরোধ আছে। তার মাদক ব্যবসার কারণে এলাকার উঠতি যুবকরা বিপথে যাচ্ছে।
রুবেল আরো জানান, গত সপ্তাহে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে। তারা জানতো আমার বোন ফিরতি এসে শ্বশুরবাড়ি যায়নি এখনো। পুরুষরা সবাই নামাজে থাকার সুযোগে হয়তো স্বর্ণালঙ্কারও লুট করার সুযোগ নিতো যদি মহিলারা প্রতিরোধ না করতেন।
বুবলির পিতা নোয়া মিয়া বলেন, তারাবি চলাকালেই গুলির শব্দ পেয়েছিলাম। নামাজ শেষ করে বাসায় আসতে চাইলে প্রতিবেশীরা বাধা দিয়ে আটকে রাখছিলেন। মেয়ের রক্ত পিতা হিসেবে হয়তো সহ্য করতে নাও পারি এই ভাবনা ছিল তাদের, যোগ করেন নোয়া মিয়া।
বুবলির জা (ভাসুরের স্ত্রী) মুন্নি আক্তার চোখ মুছতে মুছতে জানালেন, বুললিকে দেবর আকরামের বউ করে ঘরে নিয়েছিলাম সাত বছর আগে। সাত বছরে কোন দিন বুবলি ঝগড়া তো দূরে থাক গলা উঁচু করেও কথা বলেনি আমাদের সাথে।

সিসি ক্যামেরায় খুনিদের চেহারা

বুবলি আর শাহ আলমের বাড়ির মাঝে মদানী জামে মসজিদ। মসজিদের সাথেই দুটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা আছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েই ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে। ফুটেজেই স্পষ্ট ছিল শাহ আলম আর তার সঙ্গীদের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এলাকা ত্যাগের দৃশ্য।

<span>বলিরহাটে জোড়ামৃত্যু/</span> প্রতিবেশী পাশাপাশি, মাদক এসে মাঝখানে এঁকে দিল দূরত্ব 1
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের ভেতরে বুবলির লাশ আর তার পাশে খুনি শাহ আলমের লাশ।

হাসপাতালের লাশঘরে পাশাপাশি

দুপুর একটায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে বুবলির লাশ আর তার পাশে খুনি শাহ আলমের লাশ। লাশঘরের দরজার সিঁড়িতে শোকে পাথর হয়ে বসে আছে বুবলির বড় ভাই সোহেল। অপলক তাকিয়ে আছে, চোখের নয়ন যেন পাথরে তৈরি। পাশে বুবলীর স্বামী আকরাম হোসেন। আকরাম এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন লাশটা কখন পাবো? তখন পাথর হয়ে বসে থাকা সোহেলের মুখও নড়ে উঠলো, জিজ্ঞেস করলো আমার বোনের লাশটা আজ দেবে?

অবশ্য নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ মো. আবদুর রউফ মুঠোফোনে জানালেন, স্বল্পতম সময়ে লাশ বুঝে পাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

শাহ আলমের শূন্য ঘর

শাহ আলমের ঘরে গিয়ে দেখা যায় পরিবারের সব সদস্য ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এক ভাই পুলিশের হাতে আটক আছে। পুরো বাড়িতে শুধু তার চাচা রেজা মিয়া আর চাচি আছেন। রেজা মিয়া জানালেন, এই বাড়ি নিলাম হয়ে গিয়েছিল। নিলাম থেকে কিনতে শাহ আলমের পিতা হাবিবুর রহমান আগ্রহ দেখাননি। তাই রেজা মিয়া একই বাড়ি নিলাম থেকে কিনে নিয়েছিলেন। শাহ আলমের পিতাকে পরিবার নিয়ে বসবাসের সুযোগ দিয়েছেন। আর উত্তেজিত এলাকাবাসী শনিবার রাতেই শাহ আলমের ঘর গুড়িয়ে দিয়েছে।

লাশ নেবে না এলাকাবাসী

শাহ আলম পরিবারের একজন জেলহাজতে। অন্য সদস্যরা জনরোষ থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে। এ অবস্থায় শাহ আলমের লাশ বুঝে নেওয়ার কেউ নেই। এলাকার আরেক তরুণ পারভেজ হাসান জানালেন, কোনো মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজের মাটি আমাদের এলাকায় হবে না।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ মো. আবদুর রউফ জানান, ১১ মে রাতের ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে তিনটি মামলা করবে। একটি হত্যামামলা, একটি পুলিশের ওপর হামলার, অপরটি অস্ত্র উদ্ধারের। তারপর শাহ আলমের লাশের ময়নাতদন্ত হবে। এরপর একটা নির্দিষ্ট সময় আমরা অপেক্ষা করবো তার আত্মীয়স্বজন কেউ আসে কিনা। যদি না আসে তখন আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করা হবে।

উল্লেখ্য, বুবলি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার বাবা নোয়া মিয়া বাদী হয়ে শাহ আলম, তার ভাই নূর আলম (২৫), নবী হোসেন (৬০), আহমদ কবিরসহ (৪২), মো. জাবেদ (২৪) মো. মুছা (৪০) ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করে বাকলিয়া থানায় রাতেই একটি হত্যামামলা করেন।

পুলিশ দাবি করছে, মামলার সূত্রে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত শাহ আলমকে আটক করতে গেলে শাহ আলম ও তার সঙ্গীরা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। বাকলিয়া থানার ওসি নেজাম উদ্দিনসহ চার পুলিশ সদস্য আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে শাহ আলমকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠালে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!