আবার এমএলএম/ লাখ টাকার স্বপ্ন দেখিয়ে কলেজছাত্রের সঙ্গে অবিশ্বাস্য প্রতারণা

এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের গ্রেপ্তার সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা

ই-কমার্সের আড়ালে এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগে কোতোয়ালী থানা পুলিশের হাতে আটক হওয়া এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের সাত কর্মকর্তাসহ অজ্ঞাত আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বুধবার রাতে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম বাদি হয়ে কোতোয়ালী থানায় এ মামলা দায়ের করেন।

আসামিরা হলেন এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের মার্কেটিং ম্যানেজার (জিএম) রাজীব দাশ (৩৯), কর্মকর্তা অপু দাশ (২৯), রাজীব তালুকদার (৪০), উজ্জ্বল সেন (৪১), রবিন মিত্র (৩৩), সুমন বিশ্বাস (৩৮) এবং রঞ্জিত গুহ (৪৮)। এর আগে মঙ্গলবার রাতে আটকের পর বুধবার ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয় তাদের।

মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‌বুধবার রাতে এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের সাতজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো কয়েকজনকে আসামি করে জাহিদুল ইসলাম নামে একজন মামলা দায়ের করেছেন। এর আগে বিকেলে তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হলেও এ মামলায় তাদের শ্যোন এরেস্ট দেখানোর আবেদন করা হবে।

মামলার এজাহারে প্রতারিত কলেজ ছাত্র জাহিদুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ‌‌’গত ২৫ জুন বিকাল চারটায় আমি আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে কোতোয়ালী থানাধীন কাজীর দেউড়ি মোড়ের ভিআইপি টাওয়ারের তৃতীয় তলায় এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের অফিসে যাই। পরদিন আমি অফিসে না গেলে আমাকে ফোন করে ১০ মিনিটের জন্য যেতে বলে। আমার বন্ধু আমাকে রাজীব তালুকদারের কক্ষে নিয়ে যায়। এনেক্স অফিসের লোকজন আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করার পর আমাকে জানায়, তুমি ভাল ছেলে। তোমাকে আমাদের খুব ভাল লেগেছে। তুমি আমাদের অফিসে জয়েন করে সদস্য হও। তারা আমাকে অফার করে সেখানে জয়েন করলে আর চাকরি করতে হবে না। প্রতিদিন ২-৩ ঘন্টা সময় দিলে ৫০০ থেকে ১০০০ হাজার টাকা আয় করা যাবে।’ তারা আরও বলেন, ‘তুমি যদি ৫০ জন লোক যদি ভর্তি করাও তাহলে আরএমও হতে পারবে এবং প্রতি মাসের ১৪ এবং ২৮ তারিখে ২০ হাজার টাকার বেশি আয় করতে পারবে।’

এজাহারে জাহিদুল ইসলাম আরও উল্লেখ করেন, ‘স্পিকিং ইংলিশ কোর্স, মার্কেটিং কোর্স এবং কোরআন শিক্ষা কোর্স করার কথা জানিয়ে তারা আমাকে বলে, আমাদের এখানে যোগ দিলে প্রথম মাসের টাকা দিয়ে মাকে কাপড় কিনে দিতে পারবে। তাদের কথা শুনে আমার মন দুর্বল হয়ে যায়। কোন কিছু বোঝার শক্তি হারাই আমি। পাগলের মত ধার দেনা করে গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে একাধিক কিস্তিতে তাদের কথামতো পাঁচ হাজার ৮০০ টাকার বিনিময়ে ইংলিশ স্পিকিং কোর্সে ভর্তি হই।’

জাহিদুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ‘আমি তাদের অফিসে যাওয়ার পর তারা ইংলিশ কোর্স না করিয়ে ২-৩ ঘন্টা ধরে তাদের মার্কেটিংয়ের ওপর বিভিন্ন সেমিনারে থাকতে বাধ্য করে। কিন্তু স্পিকিং ক্লাসে গেলে শুধু মার্কেটিং বিষয়েই বক্তব্য রাখে। তাদের কথাবার্তা ভাল না লাগায় আমি তাদেরকে বলি আমার টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। তখন তারা আমাকে বলে টাকা দেওয়া যাবে না। তুমি সদস্য বাড়াও, বেনিফিট পাবে। পরবর্তীতে আমি কোন ব্যক্তিকে না পেয়ে তাদের প্রলোভনে পড়ে আমার বড় বোন তাসলিমাকে ৫ হাজার ৮০০ টাকা ও বন্ধু আরিফুল ইসলামকে এক হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে জয়েন্ট করাই। তাদের এখানে সদস্য হওয়ার পর তারা প্রতিনিয়ত সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।’

এজাহারে জাহিদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘প্রতিমাসে অধিক আয়ের পদ্ধতি শেখার জন্য বিভিন্ন সেমিনারের জন্য ৩০০ টাকা করে নেয় কর্তৃপক্ষ। তাদের অফিসে সদস্য নেওয়া এবং পণ্য ক্রয় করার জন্য প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। সেমিনারে তারা জানায়, তাদের এমও আহসান উল্যাহ হাসান (৩০) ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে মোটরসাইকেল কিনেছে। এছাড়াও অধিক পরিমাণে সদস্য সংগ্রহ করে দিলে কোম্পানির খরচে কক্সবাজার, ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যাওয়াসহ আরো বিভিন্ন রকম লোভনীয় অফার প্রদান করে। তাদের কার্যক্রম আমার কাছে প্রতারণামূলক মনে হওয়ায় আমি আসামিদের কাছে সদস্যপদ বাতিল করে আমার দেওয়া টাকা ফেরত দিতে বললে টাকা ফেরত না দিয়ে আমাকে মিথ্যা মামলায় জড়ানোসহ বিভিন্ন রকম হুমকি ধমকি প্রদান করে।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৭ জুন রাত ৯টা ১৫ মিনিট থেকে ৯টা ৩০ মিনিটে আমার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে ০১৯৯৮৮৬৭১৯৪ নম্বর থেকে এনেক্স ওয়ার্ল্ডের এমও আহসান উল্যাহ হাসান দুই বার ফোন করে হুমকি দিয়ে বলে তাহাদের প্রতিষ্ঠানের নামে কোন কথা বা ফেইসবুকে কিছু লিখলে বা টাকা দাবি করলে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করবে। অথচ তারা মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে আমার, বড় বোন ও আমার বন্ধু আরিফের কাছ থেকে মোট ১৩ হাজার ১০০ টাকাসহ অসংখ্য মানুষের টাকা প্রতারণামূলকভাবে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এরপর তাদের আটকের খবর পেয়ে মামলা দায়ের করলাম।’

অভিযুক্ত রাজীব তালুকদার (৪০) এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের মার্কেটিং ম্যানেজার (জিএম) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আগে ডেস্টিনি-২০০০ এর ডায়মন্ড এক্সকিউটিভ ও ডেস্টিনি ডিস্ট্রিবিউটর ফোরামের বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে চট্টগ্রামের লাভলেইন আবেদীন কলোনির বাসিন্দা রাজীব তালুকদার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নলুয়া মিলন মাস্টার বাড়ির নিরঞ্জন তালুকদারের পুত্র।

রাজীব দাশ (৩৯) এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের পরিচালক। তিনিও ডেস্টিনি-২০০০ এর পিএসডি (প্রফিট শেয়ার ডিস্ট্রিবিউটর) ছিলেন। বর্তমানে চট্টগ্রামের ঘাটফরহাদবেগের বাসিন্দা রাজীব দাশ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নলুয়া মিলন মাস্টার বাড়ির মিলন কান্তি দাশের পুত্র তিনি।

পুলিশের হাতে আটক রবিন মিত্র (৩৩) এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের চট্টগ্রাম কাস্টমার কেয়ারের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রেসিডেন্ট রাজিব মিত্রের ছোট ভাই। তিনি ছিলেন ডেসটিনির পিএসডি (প্রফিট শেয়ার ডিস্ট্রিবিউটর)। বর্তমানে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা রাজাপুকুর লেইনের বাসিন্দা রবিন মিত্র ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া সদরের উল্লাহ পাড়ার বাদল মিত্রের পুত্র। চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ই-কমার্স ও ডাইরেক্ট মার্কেটিংয়ের আড়ালে এমএলএম-এর পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছেন ডেসটিনির আলোচিত ‘ডায়মন্ড এক্সিকিউটিভ’ রাজিব মিত্র। ডেসটিনির বিরুদ্ধে সারা দেশে অভিযান শুরুর পর তিনি ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড ডিস্ট্র্রিবিউটর (বিনিয়োগ) ফোরাম নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলে ডেসটিনির পক্ষে মানববন্ধনসহ বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। ২০১২ সালে এমএলএমের নামে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর ডেসটিনির বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান শুরু হলে ডেসটিনি চট্টগ্রামের ‘সমন্বয়ক’ রাজিব মিত্র আত্নগোপনে চলে যান।

আটককৃতদের মধ্যে আরও রয়েছেন বোয়ালখালী কানুনগোপাড়ার হিমাংশু সেনের পুত্র উজ্জ্বল সেন (৪১) এবং পটিয়ার ছনহরার বাউলডাঙ্গা এলাকার সূর্য মোহন বিশ্বাসের পুত্র সুমন বিশ্বাস (৩৮)। এরা দুজনই ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডে কথিত ‘ডায়মন্ড এক্সিকিউটিভ’ ছিলেন। আটককৃতদের মধ্যে এছাড়া রয়েছেন পাহাড়তলী উত্তর কাট্টলীর মনিন্দ্র গুহের পুত্র রঞ্জিত গুহ (৪৮) এবং নগরীর আসকারদিঘীর পশ্চিম পাড়ের বাসিন্দা অপু দাশ (২৯)। অপু ছিলেন এমএলএম প্রতারণার দায়ে বহুল আলোচিত স্পিক এশিয়া ও ইউনিপের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। বর্তমানে এরা সবাই এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্বে রয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতারণা ও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের দায়ে সরকার কর্তৃক বন্ধ করে দেওয়া এমএলএম কোম্পানি ‘ডেসটিনি-২০০০ লি:‘এর কথিত ডায়মন্ড এক্সিকিউটিভরাই ‘এনেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ নামের প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। ২০১২ সালে ডেসটিনির বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান চলাকালে এদের প্রায় সবাই গ্রেপ্তারের ভয়ে দেশের বাইরে পলাতক ছিলেন। আবার কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। সুযোগ বুঝে এরাই এখন ই-কমার্স পদ্ধতির নামে নতুন কৌশলে প্রতারণার ফাঁদে আটকে রেখেছেন শত শত তরুণ-তরুণীকে। আর চট্টগ্রামে হাজার টাকা বিনিয়োগ করে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এসব গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের নাম।

এডি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!