জীবিকা হারিয়ে টেকনাফে হাজারো জেলের হাহাকার

রফিক আহমদ (৫০)। বয়সের অর্ধেকের বেশি (প্রায় ৩০ বছর) সময় ধরে নাফ নদীতে মাছ শিকার করে সংসার চালাতেন। তার জীবিকার একমাত্র সম্বল ছিলো এই নাফ নদী। মাছ বিক্রির টাকায় চালাতেন পরিবার। হঠাৎ তাদের জন্য মানবিক দুর্যোগ হয়ে এসেছে লাখো রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে সৃষ্ট সহিংসতায় ২০১৭ সালের আগস্টের পর থেকে এদেশে পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। এ সময় থেকে ইয়াবাপাচারও বেড়ে যায় বহুগুণে। এই দুই কারণে তখন থেকে প্রশাসন নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ রেখেছে। জীবিকার একমাত্র অবলম্বন বন্ধ থাকায় অনাহারে ও অর্ধাহারে দিন পার করছেন রফিক। তিনি টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বাবিল এলাকার নজির হোসেনের ছেলে।

উত্তরপাড়া মৃত অজি উল্লাহর ছেলে মোহাম্মদ হোসেন। নাফ নদীতে মাছ শিকারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কর্মঠ এই জেলের ঘরে হাহাকার চলছে।

জীবনের অধিকাংশ সময় মাছ শিকার করায় অন্য কোনো কাজ তার জানা নেই। হোয়াইক্যং ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় ৩০০ জেলে রয়েছে, নাফ নদীতে মাছ শিকার করাই যাদের একমাত্র জীবিকা। জেলেদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য ২০১৮ সালে একটি তালিকা অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে মৎস্য অধিদপ্তর। এই তালিকায় হোয়াইক্যং ইউনিয়নের শুধুমাত্র দুই নম্বর ওয়ার্ড থেকে অন্তর্ভূক্তি হয়েছেন ৭৬ জন জেলে। বাকিরা এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে পারেননি। আবার তালিকায় অনেকেই জেলে নন এমন ব্যক্তিরা স্থান পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।

এলাকাবাসীর পক্ষে রফিক জানান, লম্বাবিলের আজিজুর রহমানের ছেলে আবু তাহের, মোহাম্মদ সুলতানের ছেলে মোহাম্মদ আলী জেলে না হয়ে তালিকায় অন্তর্ভূক্তি হয়ে বিশেষ ভিজিএফের সুবিধা গ্রহণ করেন। অথচ আসল জেলেরা না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। তারা ভিজিএফ পাচ্ছেন না। অপর দিকে নকল মৌসুমী জেলে সেজে অনেকে ভিজিএফের সুবিধা নিচ্ছেন। এসব যাচাই-বাছাই করার দাবি জানান তিনি।

জীবিকা হারিয়ে টেকনাফে হাজারো জেলের হাহাকার 1

নাফ নদীনির্ভর কয়েক হাজার জেলে থাকলেও অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৪৪১ জেলে। এর বাইরেও হাজার জেলে তালিকাভুক্তির বাইরে রয়েছেন।

টেকনাফ মৎস্য অফিস থেকে জানা গেছে, পূর্বে জেলেদের সংজ্ঞা ছিল, বছরে নূন্যতম ৬ মাস সাগরে বা নদীতে মাছ শিকার করলে তাদেরকে জেলা বলা হবে। সম্প্রতি এ সংজ্ঞাকে ৩ মাস করা হয়েছে। যে সব জেলে এই সংজ্ঞার আওতায় আসবে তাদেরকে পরবর্তীতে তালিকাভুক্ত করা হবে বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি শাহপরীর দ্বীপে অভাব-অনটনের কারণে এক জেলে আত্মহত্যা করেছেন। জেলেরা জানান, সরকার যে জন্য মাছ শিকার বন্ধ রেখেছে, তা মোটেও সফল হয়নি । ঠিকই রোহিঙ্গারা নাফ নদী এপার-ওপার করছে। সেই সাথে ইয়াবার বড় বড় চালান এ দেশে ঢুকেছে। তারা দ্রুত মাছ শিকারের বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।

হোয়াইক্যং ২ নম্বর ওয়ার্ড বঙ্গবন্ধু জেলে পরিষদের সহ-সভাপতি আলী আজগর বলেন, গুটি কয়েকজন জেলেদের তালিকাভুক্ত করে দুয়েকবার ভিজিএফ দেওয়া হয়েছে, যা অপ্রতূল। ভুয়া জেলেদের নয়, প্রকৃত জেলেদের তালিকাভুক্ত করে প্রতিমাসে সরকারের বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানান তিনি। অন্যথায় মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইয়াবা ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অজুহাতে টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে প্রায় ১০ হাজার জেলে। টেকনাফে বেশ কয়েকটি জেলে পাড়া রয়েছে। এরমধ্যে হোয়াইক্যংয়ের লম্বাবিল, হ্নীলার হোয়াব্রাং, নাটমুড়ার জেলেপাড়া, জাদীমুরা, খারাংখালী, টেকনাফের জেলেপাড়া, কায়ুকখালী পাড়া, নাজির পাড়া, সাবরাংয়ের চৌধুরীপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জেলেপাড়া, খারিয়াখালী, মাঝের পাড়া অন্যতম।

বিজিবি জানিয়েছে সরকারের নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত কোনো ধরণের মাছ শিকারের সুযোগ নেই।

টেকনাফের সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, জেলেরা নাফ নদীতে মাছ শিকার করতে না পেরে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। ১ হাজার ৪৪১ জেলেকে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। তাদেরকে ইতিমধ্যে সাহায্য-সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। যেসব জেলে বাদ পড়েছে তাদেরও পর্যায়ক্রমে তালিকাভুক্ত করা হবে। পাশাপাশি জেলেদের মাছ শিকারের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল হাসান জানান, বিভিন্ন কারণে জেলে সম্প্রদায় মাছ শিকার করতে পারছেননা। তবে মন্ত্রণালয় থেকে মতামত জানতে চাইলে জেলেদের পক্ষে (মাছ শিকারের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সেবাদানকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানদের জেলেদের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!