রক্তদান/ লাল ভালোবাসা বিলিয়ে অন্যের জীবন বাঁচান তাঁরা

স্বার্থের জন্য এ পৃথিবীতে যখন একদিকে রক্তপাত হচ্ছে প্রতিনিয়ত; অন্যদিকে নিয়মিত নিজের লাল রক্তের ভালোবাসায় বাঁচিয়ে তুলছেন একেকটি জীবন। রক্তদানের মাধ্যমে শুধু জীবনই বাঁচাচ্ছেন না তারা, এ কাজ করে তারা পাচ্ছেন মানসিক প্রশান্তি-আত্মতৃপ্তিও। সেজন্য একবার রক্তদানের পর মুখিয়ে থাকেন কখন শেষ হবে ৯০ দিন! অনেকের ভাষায় তাদের বলা হয় ‘রক্তমানব’। আবার অনেকের ভাষায় রক্তযোদ্ধা বা লাল ভালোবাসাদানকারী এরা। এরকমই লাল ভালোবাসা বিলিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসা পাঁচজন রক্তদাতার সঙ্গে চট্টগ্রাম প্রতিদিন কার্যালয়ে কথামালায় সাজিয়েছিলেন আলম দিদার। ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদান দিবস ছিল এ আলাপচারিতার উপলক্ষ।

সুঁই সিরিঞ্জের ভয়কে জয়
সুঁই সিরিঞ্জ দেখলেই রীতিমত কাঁপাকাপি শুরু হতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী প্রিয়াংকা দাশের। কিন্তু আজ থেকে দুই বছর আগে যখন নিজের দিদির ডেলিভারির সময় তাৎক্ষণিক রক্তের প্রয়োজন হয়, তখন অনেক সাহস করে রক্ত দিতে রাজি হন প্রিয়াংকা। প্রিয়াংকা বললেন, ‘আমি আসলে সুঁই সিরিঞ্জ এসবকে খুব ভয় পেতাম। এর মধ্যে রক্তদান—তা তো রীতিমতো ভয়ের বিষয়! কিন্তু একদিন দিদির ডেলিভারির সময হঠাৎ করেই রক্তের প্রয়োজন হলে আমি অনেক সাহস করে তাকে রক্ত দিতে রাজি হই। একটু ভয় কাজ করলেও পরে মনে শান্তি পেলাম এই ভেবে—আমার রক্তের কারণে হয়তো দিদির জীবন বাঁচাতে সহযোগিতা করেছি। এরপর থেকে আমি রক্ত দিতে উৎসাহিত হই। পরে রক্তদান সংগঠন কণিকার মাধ্যমে আরও একবার রক্ত দিয়েছি। আমি এখন প্রস্তুত রক্ত দিতে যখনই ডাক পড়ুক।’

<span>রক্তদান/</span> লাল ভালোবাসা বিলিয়ে অন্যের জীবন বাঁচান তাঁরা 1
(বাঁ থেকে) কামরুল ইসলাম শাকিল, আমরিন এহসান, প্রিয়াংকা দাশ, সারোয়ার ইসলাম রুহেত ও নাঈমুল হাসান

যখনই ডাক, তখনই হাজির
প্রিয়াংকার গল্পের চেয়ে একটু অন্যরকম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ছাত্রী আমরিন এহসানের গল্পটা। তিনি নিজ থেকেই সম্পৃক্ত হয়েছিলেন স্বেচ্ছায় রক্তদানের ক্যাম্পেইনে। নাসিরাবাদ গার্লস স্কুলে ক্যাম্পেইন চালানোর সময়েই নিজের রক্তদানের মাধ্যমে যুক্ত হন এ আন্দোলনে। ‘ও নেগেটিভ’ রক্তের অধিকারী আমরিনের কাছে যখনই রক্তদানের ডাক আসে, তখনই তিনি হাজির হন রক্ত দিতে। এ পর্যন্ত তিনি ছয় বার রক্ত দিয়েছেন। অনেক মুমূর্ষু রোগী হয়তো বেঁচে গেছে তার রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে। তিনি বলন, ‘যতদিন আল্লাহ শরীর সুস্থ রাখবে ততদিন আমি আমার লাল ভালোবাসা (রক্তদান) মানুষকে দান করে যাব।’

এবি পজেটিভ বিলানোই তার নেশা
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের বাসিন্দা সারোয়ার ইসলাম রুহেত। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (আইআইইউসি) থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক শেষ করেছেন। তার বন্ধুমহলটাও অনেক বড়। আজ থেকে সাত বছর আগে একদিন নিজ বাসায় বসে আছেন। এ সময় তার এক বন্ধুর ফোন আসে—অপারেশনের টেবিলে থাকা এক প্রসূতি রোগীর জন্য রক্ত দিতে হবে। রক্তের গ্রুপ যেহেতু এবি পজেটিভ সেই গ্রুপের রক্তও এতো বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাকে আসতেই হবে। এমন কথা শুনে রুহেত নিজের সাইকেল চেপে খাজা রোড থেকে আন্দরকিল্লা রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে আসেন রাত ১১টায়। প্রথমবার হলেও সাহস করে রক্তদান করে ওই প্রসূতির জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখেন। সেই থেকে রক্তদানের যে নেশা তাকে পেয়ে বসেছে সেটা এখনো অব্যাহত আছে। এখন পর্যন্ত মোট ১৭ বার নিজের লাল রক্ত অন্যের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন এ তরুণ।

‘কাণ্ডারী’র মাঝি
রুহেতের মত আরেক ‘পাগল’ রক্তদাতা হলেন নগরীর মোহরার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম শাকিল। পড়ালেখা করেছেন আইআইসিইউ থেকে কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে। তিনি শুধু রক্ত দিয়েই ক্ষান্ত নন, আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছেন রক্তদান সংগঠন ‘কাণ্ডারী’। এ সংগঠনের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রতিনিয়ত রক্তদান করে আসছে সংগঠনটি। শাকিলের মুখেই শুরুর দিককার কথা—’আমার খালাত ভাইরা রক্তদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় আমি বিষয়টি সম্পর্কে জানতাম। ২০০৯ সালের দিকে খালাতো ভাই জানালেন, একজন গরিব নারীর ডেলিভারির সময় রক্তের প্রয়োজন। রক্ত না পেলে জীবন সংকটাপন্ন। নিজের রক্তের গ্রুপ যেহেতু জানা আছে, তাই উনাকে রক্ত দিতে ছুটে যাই। রক্ত দেওয়ার পর যথারীতি উনার অপারেশন সাকসেফুল হলো। উনিও সুস্থ হলেন। এখনও কিন্তু ওই নারী আমাকে পরম শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। আমার জীবনে এটাই পরম প্রাপ্তি। সেই থেকে শুরু রক্তদান। এ পর্যন্ত মোট ২৫ বার রক্ত দিয়েছি। আমরা নিজেরাই একটি রক্তদানের সংগঠন করেছি ‘কাণ্ডারী’ নামে। সেটি এখন রক্তদানের বিশাল প্লাটফরম হয়ে উঠেছে।’

রক্তদানেই প্রশান্তি যতো
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষা গবেষণা অনুষদের ছাত্র নাঈমুল হাসান। তিনি নাসিম নামে তার এক বন্ধুর হাত ধরে ২০১৬ সাল থেকে রক্তদান সংগঠন কণিকার মাধ্যমে এ আন্দোলনে যুক্ত হন। একজন গর্ভবতী নারীকে রক্তদানের মাধ্যমেই তার রক্তদানের শুরু। এবি পজেটিভ রক্তের অধিকারী নাঈম এখন পর্যন্ত তিনি মোট ছয়বার রক্ত দিয়েছেন।

রক্তদান শুধুই কি মানবিক বিবেচনা?
আড্ডায় কথা উঠে রক্তদানে কেন তারা অনুপ্রাণিত হলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে সকলেরই উত্তর প্রায় অভিন্ন। তবে বলার ধরন ভিন্ন। যেমন নাঈমুল হাসান বললেন, ‘এ কাজটির মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে। সমাজে অনেকে অনেকভাবে কন্ট্রিবিউট করেন। সবাই সব কিছু করবে তা না। আমি মনে আমি রক্তদানের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে নিজের ভূমিকা রাখছি। সবাই সব সেক্টরে কাজ না করে কেউ কেউ নির্দিষ্ট সেক্টরে কাজ করলে সমাজ পরিবর্তন হবে। মানুষ মানবিক হবে। একটা মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। মূলত মানবিক বিষয়টি বিবেচনা করেই রক্তদানে অনুপ্রাণিত হই।’

আবার রক্তদানের জন্য বহুবার নানা সংগঠন থেকে পুরস্কার পাওয়া কামরুল হাসান শাকিল বললেন, ‘মানুষ হিসেবে জন্ম নিলেই মানুষ হয় না। আমার মতে আমরা জাস্ট একটা প্রাণী! যখনই আমাদের মধ্যে মানবিকতাবোধ কাজ করবে তখনই আমরা মানুষ হব। সেই বোধ থেকেই সমাজের নানা দায়বদ্ধতার মাঝে আমি মনে করি রক্তদান একটা গুরুত্বপূর্ণ ও মহৎ কাজ। অন্য কাজে যেমন মানুষের উপকারে আসা যায় তার চেয়ে রক্তদানটা বেশি উপকারে আসে। রক্তদানের মাধ্যমে একজন মানুষের সরাসরি জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখে। তাই আমি ও আমার সংগঠন রক্তদানের জন্য কাজ করছি।’

প্রিয়াংকা দাশ বললেন খুব সহজভাবেই—’রক্তদান একটি মহৎ কাজ। এ মহৎ কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। সেই হিসেবে আমি রক্তদানের মত এ কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী আমরিন এহসান বললেন, ‘আমার যখন রক্তের প্রয়োজন হবে তখন আমার জন্যও হয়তো আমার মত কেউ রক্ত দিতে এগিয়ে আসবেন। আমারও সেই বোধ থেকে রক্তদানে এগিয়ে আসা। আমার রক্তে একজন মানুষের জীবন বাঁচবে—বিষয়টি ভাবতেই অন্যরকম অনুভূূূূতি কাজ করে। নিজের রক্তে অন্যের বেঁচে থাকা দেখাটাই অন্যরকম মানসিক প্রশান্তি।’

সারোয়ার ইসলাম রুহেত বললেন, ‘মানুষের সেবা করার জন্য আমার কাছে রক্তদানই হচ্ছে সেরা মাধ্যম। হাসপাতালে আমার এক নিকটাত্মীয়ের রক্তের প্রয়োজনের সময় দেখেছি রক্তদানের বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যতদিন সুস্থভাবে বেঁচে আছি ততদিন মানুষের মাঝে নিজের রক্ত বিলিয়ে যাব।’

রক্তদানের পর রোগীর স্বজনদের প্রতিক্রিয়ার কথা জানাতে গিয়ে নাঈমুল হাসান বললেন, ‘আমি একদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপরিচিত এক গর্ভবতী নারীকে রক্তদান করি। বের হওয়ার পর উনার স্বামী আমাকে জড়িয়ে ধরে যেভাবে কান্না করেছেন আর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সেটাই আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। ওই সময়ের অনুভূতি আমি কখনো ভুলতে পারব না।’

শাকিল যোগ করেন, ‘আমি অনেককে রক্ত দিয়েছি। প্রায় সবাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তবে কারও কারও কাছে আমি যেন তাদের পরম পূজনীয়। তারা যেভাবে শ্রদ্ধা সম্মান আর ভালোবাসেন সেটা বলার মত না। এটা অন্য কোন সেবায় পাওয়া যায় না।’

মনোবেদনার টুকটাক
নিজের প্রশান্তির যেমন সুখ স্মৃতি আছে তেমনি রক্ত দিতে না পেরে মনোবেদনার স্মৃতিও আছে। এখনো তাদের সেই কষ্টগুলো পীড়া দেয় এ পাঁচ রক্তদাতাকে। অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়েই জানালেন সেই কথা। আমরিন এহসান বললেন, ‘এক বছর আগে সদ্যজাত এক মেয়ে শিশুর জন্য রক্তের প্রয়োজন জরুরিভিত্তিতে। কণিকার মাধ্যমে ওই শিশুর মা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু আমি অসুস্থ থাকায় রক্ত দিতে পারিনি। পরে যখন ওই আপুটা (শিশুর মা) আমাকে ফোন করে জানালেন শিশুটি রক্ত না পাওয়ায় মারা গেছে—একথাটি শুনে আমি প্রচণ্ড কেঁদেছি। অনেক দিন নিজকে ক্ষমা করতে পারিনি। এ বিষয়টি আমাকে এখনো পীড়া দেয়।’

স্মৃতি হাতড়ে প্রিয়াংকা দাশ বললেন, ‘কয়েক মাস আগে রাত দশটার দিকে ফোন আসে রক্ত দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি যেহেতু পরিবারের সঙ্গে থাকি তাই বাসা থেকে এতো রাতে বের হওয়ার অনুমতি পাইনি। বিষয়টির জন্য খুব মন খারাপ হয়েছিল। পারিবারিক সীমাবদ্ধতার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রক্ত দিতে পারিনি।’

রুহেতের অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্যরকম। তিনি বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত ১৭ বার রক্ত দিয়েছি। যখনই ডাক পড়ে তখনই রক্ত দিয়েছি। কিন্তু মাঝেমধ্যে রক্ত দেওয়ার মাসদুয়েকের মধ্যে যখন ডাক আসে তখন সেটা তো সম্ভব হয় না। কেননা রক্ত দিতে অন্তত ৯০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এরপরও আমি নিজে না পারলে অন্যদের কাছ থেকে হলেও ম্যানেজ করার চেষ্টা করি।’

নাঈম বললেন, ‘রক্তদান এখন আমার কাছে নেশার মত। আমি ডাক পেলেই চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক সময় পরিবার থেকে মা বারণ করে, অনেক সময় অসুস্থ থাকি। তখন যখন ডাক আসে খুব খারাপ লাগে রক্ত দিতে পারি না বলে। তখন মনের মধ্যে এক ধরনের কষ্ট লাগা কাজ করে।’

রক্তদান নিয়ে নিজের কোনো অতৃপ্তি নেই শাকিলের। যখনই ডাক পড়ে সময় হলেই রক্ত দেন তিনি। যদি সময়ের আগে ডাক পড়ে, দ্রুত সময়ের মধ্যেই নিজ সংগঠন কিংবা পরিবার থেকে রক্ত ম্যানেজ করে দিয়ে থাকেন ‘কাণ্ডারী’র এ সভাপতি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!