স্বজনহারা এই অনাথ প্রতিবন্ধীদের জীবনে ঈদ বলে কিছু নেই

ঈদ মানে কী—জানতে চাইলে ফিক করে হাসে আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শিশু নিরব। কথা হলো নিরব, মায়া ও মামুনের সাথে। ছবি তুলতে চাইলে দাঁড়িয়ে ‘পোজ’ দেয়, অথচ ওরা জানে না বাবা-মা, পরিবার, স্বজনের স্নেহ কী? ঈদ নিয়ে তাই ওদের কোনো অনুভূতি নেই, স্বপ্ন নেই। ওরা জানে না এমনকি নিজের পরিচয়টুকুও!

চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অনাথ ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়স্থল।
চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অনাথ ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়স্থল।

এদের কেউ এসেছে প্রশাসন বা আদালতের মাধ্যমে, কাউকে পাওয়া গেছে রাস্তায়, কাউকে দিয়ে গেছে নিজেরই পিতা বা মাতা। চট্টগ্রামের রৌফাবাদে এই অনাথ ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের ‘নিবাস’।

চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অনাথ ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়স্থল।
চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অনাথ ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়স্থল।

ঈদের দিন গিয়ে দেখা যায়, অনেকে চলাফেরা, কাপড় পরিধান, গোসলসহ নিজের পরিচ্ছন্নতার কাজটুকুও করতে অক্ষম। কারও শরীরের একাংশ অবশ। চলাফেরা করতে পারে না। কেউবা মানসিক রোগী—যাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাই দুঃসাধ্য, ওদের কক্ষ থেকে সচরাচর বের করা হয় না। তাদের কক্ষের সামনে যেতেই গায়ে হামলে পড়তে চাইল। কেউবা গান ধরল আগন্তুককে দেখে।

চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অনাথ ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়স্থল।
চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অনাথ ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়স্থল।

জানা যায়, ঈদের দিনে সবাই নতুন পোশাক পরেছে। ঈদের সকালে তাদের সেমাই, বাকরখানি দিয়ে নাশতা আর বেলা ১১টায় নুডলস দেওয়া হয়। দুপুরের খাবারের মেনু্তে ছিল পোলাও, খাসির রেজালা, মুরগির রোস্ট, কোমল পানীয়, সালাদ ও দই। সবাই লাইন ধরে আগ্রহ নিয়ে খেয়েছে। বিকেলে একটি করে আপেল দেওয়া হয় সবাইকে। রাতের খাবারে ছিল সাদাভাত, ডিম ভুনা, চটপটি ও সবজি।

চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অনাথ ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়স্থল।
চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অনাথ ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়স্থল।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় হাউসপ্যারেন্টসের দায়িত্বপালনকারী প্রিয়াংকা মুহুরী, উচ্চমান সহকারী মঞ্জুরী চাকমা, অফিস সহায়ক মো. আলীর সাথে। তারা বলেন, ‌এখানে যারা রয়েছে তাদের কোন পরিচয় নেই। প্রশাসন আমাদের এনে দেয়। আমরা দেখাশোনা করি। ঈদের দিন সবাইকে ভালো মানের খাবারসহ বিভিন্নভাবে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি।

এখানে এসেছিলেন পাঁচলাইশ কোলগাঁও থেকে সমাজকর্মী আবদুল কাদের, বিএসআরএমে কর্মরত আলমগীর। তারা জানান, তারা এখানে এই প্রথম এসেছেন। এখানে আসলে প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করার তাগাদা অনুভব করেন।

প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ (উপ-পরিচালক) আবুল কাশেম জানান, ঈদের দিনে আমরা বাচ্চাদের ভালো খাবার সহ নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা করি। তবে আমাদের ডাক্তার ও আয়া সংকট রয়েছে। এ কারণে চাইলেও অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না।

তার কাছ থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে বাশঁখালী থানা মানসিক প্রতিবন্ধী মায়াকে (১৩), ২০১৯ সালে ত্রিশাল ময়মনসিংহ থেকে বহুমাত্রিক মানসিক রোগী মো মামুনকে, ২০১৫ সালে গাজীপুর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে নিরব, ২০১৮ সালে ডবলমুরিং থানা ডাউন সিনড্রম রোগী সাব্বিরকে রেখে যায়। অাবার অনেক মা- বাবা নিজের প্রতিবন্ধী বাচ্চাকে অপরিচিত বলে জানিয়ে প্রশাসনের মাধ্যমে এখানে রেখে যান। বর্তমানে এখানে রয়েছে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী ১২৩ জন ( ছেলে ৭৭ ও মেয়ে ৪৬), সেরিব্রাল পালসি (২২ ছেলে ও ১২ মেয়ে ১০), অটিজম ১০ (ছেলে ৭ ও ৪ জন), ডাউন সিনড্রম ১৫ ( ছেলে ১০ ও মেয়ে ৪ )।

জানা গেছে, ২০০০ সালে চার একর জমির উপর ৩ কোটি ১২ লাখ টাকায় নির্মিত এই প্রতিষ্ঠানে বালক- বালিকা হোস্টেল রয়েছে দুটি। সাত ইউনিটের স্টাফ কোয়ার্টারসহ পুরো প্রতিষ্ঠানে ১১টি ভবন রয়েছে। একজন অধ্যক্ষ ( উপ-পরিচালক) একজন হাউজ প্যারেন্টসসহ মোট ১৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে। আটটি সিসিটিভি ক্যামেরায় পুরো কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রতি নিবাসীর জন্য মাসিক বরাদ্দ মোট দুই হাজার ৬০০ টাকা। প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি কিছু কিছু অনুদানও মেলে।

কর্তৃপক্ষ জানায়, মোস্তফা হাকিম ফাউন্ডেশন ও শফি মোটরস দুই আয়ার ব্যয়ভার বহন করে। ডা. ফিরোজা মেহের নামে একজন ব্যক্তি ২০১৬ সাল থেকে দুই আয়ার ব্যয়ভার বহন করে আসছিলেন, যদিও তিনমাস ধরে তা বন্ধ আছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়মিত ডাক্তার, আয়া, নার্স ও গাড়ির সংকট রয়েছে। ১৯৯৭ সালে কেনা একমাত্র মাইক্রোবাসটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।

২০১৮ সাল থেকে ঈদের পরদিন সাবেক মেয়র মনজুরুল আলমের বাসায় ১৫ জন প্রতিবন্ধীর দাওয়াত থাকে বলেও তিনি জানান।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের রৌফাবাদে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠানটি সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত হয়। এখানে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিবন্ধী শিশুদের ভরণপোষণসহ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষার পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি, স্পিচথেরাপি ও সাইকোথেরাপি দেওয়া হয়। সরকারি শিশু পরিবার, ছোটমনি নিবাস বিভাগে শারীরিক, মানসিক, অটিস্টিক, সেরিব্রাল পলসি, ডাউন সিনড্রমসহ বিভ্ন্নি ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধী রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৭০ জন প্রতিবন্ধী অনাথের বসবাস এখানে।

এসএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!