বন্দর-সিডিএর সমন্বয়হীনতায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা বছরের পর বছর ভুগিয়ে চলেছে নগরবাসীকে। সংস্থাগুলোর কোনোটিই পরষ্পরের সাথে সমন্বয় করে না। প্রকল্প গ্রহণে কোন সংস্থা অন্য সংস্থাকে তোয়াক্কাও করে না। যানজট, জলাবদ্ধতা, সড়কের বেহাল অবস্থাসহ সব নাগরিক দুর্ভোগের জন্য দায়ী করা হয় সেবা সংস্থাসমূহের সমন্বয়হীনতাকে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম শহরে বাস্তবায়নাধীন একটি আলোচিত প্রকল্প গ্রহণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বিরুদ্ধে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে ওই প্রকল্প ব্যর্থ হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে সিডিএ।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্ট ‘লালখানবাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ’ প্রকল্প বন্দর কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই গ্রহণ করেছে সিডিএ। এ বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের কোন মতামত নেওয়া হয়নি। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তা বন্দরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে টাইগারপাসের পাহাড় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা জানিয়ে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনও করেছে একটি সংগঠন। একই সাথে এই প্রকল্পের দরপত্রেও অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছিল।

chittagong elevated expressways

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই প্রকল্পে আমাদের কিছু অবজারভেশন (আপত্তি) আছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বন্দর সংশ্লিষ্ট রাস্তা ব্লক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বন্দরের পণ্য ডেলিভারির কাজও এতে বাধাগ্রস্ত হবে।’

এই প্রকল্পে কী পরিকল্পনা আছে এবং বন্দরের কাজে যাতে বিঘ্ন না ঘটে, তা জানাতে সম্প্রতি সিডিএকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান মো.ওমর ফারুক।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘লালখান বাজার থেকে শাহ্ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ’ প্রকল্পের বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ অবগত নয় বলে জানানো হয়েছে। ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় একথা জানান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম।। বন্দরের সামনে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প বন্দর কর্তৃপক্ষ অবগত না থাকলে প্রকল্পটি ব্যর্থ হতে পারে বলে ওই সভায় আশংকাও প্রকাশ করেন তিনি।

chittagong elevated expressway

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো. জাফর আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন,‘আমরা এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট সিডিএর কাছে চেয়েছিলাম। তারা দিতে পারেনি। এছাড়া গাড়ি চলাচলের ইমপ্যাক্ট রিপোর্টও তারা দিতে পারেনি। আমরা এই দুটি রিপোর্ট দিতে বলেছি।’

জাফর আলম আরো বলেন, ‘বন্দর ঘেষে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আইএসপিএস কোড অনুযায়ী সমস্যা হবে। বন্দরের সীমানা ঘেষে এই প্রকল্পের কাজ পরিচালনা করা হলে তা বন্দরের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। চট্টগ্রাম বন্দর মনে করে, এই প্রকল্পের জন্য আরো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।’

এ বিষয়ে সিডিএর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই প্রকল্প গ্রহণে সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের বড় ভূমিকা ছিল। প্রকল্প অনুমোদনের জন্য যা যা করার দরকার তার সবই করেছেন উনি। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সাথে লবিং পর্যন্ত করেছেন। এদিকে গত বছরের জুলাই মাসে ওই প্রকল্পের কাজ বিশেষ একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে সিডিএর দরপত্রে নিজেদের মত করে শর্ত জুড়ে দিয়েছে বলে লিখিত অভিযোগ পাঠানো হয় ঢাকায়। ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়লে দরপত্রে পরিবর্তন আসে। তকে এরপরও তাতে এমন কিছু শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে যাতে নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পায় বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে সেভ টাইগার পাস মুভমেন্ট-এর সদস্য সচিব আদিল কবির বলেন, ‘এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে টাইগারপাসের পাহাড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এই প্রকল্পের কাজ যেন টাইগারপাসের পর থেকে করা হয়। লালখানবাজার থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত জায়গাটি যেন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা না হয়। আমরা টাইগারপাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও ভারসাম্য হারাতে চাই না।

chittagong elevated expressway

প্রকল্প গ্রহণে বন্দরকে না জানানোর বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘না জানার কিছু নেই। বন্দরের এই প্রকল্পে অর্থায়ন করার কথা ছিল।’

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘এ প্রকল্প গ্রহণ করার আগে এর সুবিধা-অসুবিধা ও আমাদের কোন মতামত আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চায়নি সিডিএ। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে একটি সংগঠনের আন্দোলন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এ প্রকল্পের জন্য আমরা কোন পাহাড় কাটবো না।’

এ ব্যাপারে সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রকল্পের বিষয়ে বন্দরের সাথে আমরা সভা করেছি। তারা এই প্রকল্পে সাপোর্ট দিতে প্রস্তুত ছিল। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বন্দর এলাকা যানজটমুক্ত থাকবে। চট্টগ্রাম বন্দরই এই প্রকল্পের সুফল ভোগ করবে।’

প্রকল্প সম্পর্কিত তথ্য

৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ ৯৪ হাজার প্রাক্কলিত ব্যয়ের এই প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেকে অনুমোদিত হয়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের অধীনে রয়েছে ১৬ দশমিক ৫০ মিটার প্রস্থের ও ১৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ফ্লাইওভার নির্মাণ। ৯ জংশনে র‌্যাম্প থাকবে ২৪টি। আরো থাকবে ১৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রি-কনস্ট্রাকশন অব পেভমেন্ট এবং একই মাপের রোড মেইনটেনেন্স।

প্রকল্পের অধীনে আছে ১১ হাজার ৫৫১ বর্গ মিটার রোড মার্কিং, ১৩৮ কাঠা জমি অধিগ্রহণ, ২ হাজার ৯৬ দশমিক ৮৬ বর্গ মিটার স্থাপনার ক্ষতিপূরণ, তিন হাজার বৈদ্যুতিক পোল স্থানান্তর এবং আড়াই হাজার এলইডি লাইট স্থাপন (পোল, ক্যাবল ও সোলার সিস্টেম)

প্রকল্প বাস্তবায়নে দরদাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-রেনকেন জয়েন্ট ভেনচার বরাবর গত বছরে ২৯ অক্টোবর দুই হাজার ২০ কোটি চার লাখ ৬৭ হাজার ৬০ টাকার নোটিফিকেশন অফ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়েছে এবং ৩০ অক্টোবর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে ডিডিসি-এসএআরএম-ডিপিএম-এইচএনআরবিআই (জেবি)কে নিয়োগ করা হয়েছে।

প্রকল্পের অগ্রগতি

এই প্রকল্পের কাজের সুবিধার্থে কর্ণফুলী টানেল থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সিমেন্ট ক্রসিং থেকে কাঠগড় পর্যন্ত প্রায় ৫৫ পাইলের কাজ শেষ হয়েছে। পাঁচটি টেস্টপাইল সম্পন্ন হয়েছে। উল্লেখিত স্থানে নিরাপত্তা ফেন্সিংয়ের বাইরে প্রয়োজনীয় দুই লেইন রাস্তা রাখার জন্য প্রায় দুই কিলোমিটার কার্পেটিংসহ রাস্তা প্রশস্তকরণ কাজ শেষ হয়েছে এবং রাস্তার দুই পাশে ড্রেন ও ফুটপাতে নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া লালখান বাজার থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত প্রায় ৪৫০টি সয়েল টেস্টের কাজ শেষ হয়েছে।

অবশ্য লালখানবাজার থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত অবৈধ স্থাপনা নিয়ে বিপাকে আছে সিডিএ। দেওয়ানহাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত ডিজাইন রিভিউ করা হবে। সামগ্রিকভাবে প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ১০ শতাংশ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!