বিআরটিএর ৩৫ কোটি টাকার সিএনজি স্ক্র্যাপ বাণিজ্য, ঘুষ লেনদেন চার শোরুমে, জামালের মোবাইলে যায় ‘ক্লিয়ারেন্স’

১৫ বছরের পুরনো সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ক্র্যাপ ঘোষণার আওতায় এনে নতুনভাবে রেজিস্ট্রেশনযোগ্য করার নামে ৩০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিআরটিএভিত্তিক একটি সিন্ডিকেট। অথচ এসব গাড়ি স্ক্র্যাপ করতে সরকারি কোনো খরচের খাত কিংবা বিধান নেই। এরপরও ‘স্ক্র্যাপ ঘোষণা’র আওতায় পড়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা মালিকদের গুণতে হচ্ছে হাজার থেকে লাখ টাকার ঘুষ। এরই মধ্যে ছয় হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে স্ক্র্যাপযোগ্য করার নামে আনুপাতিক হিসাব অনুসারে অন্তত ৩৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিআরটিএ’র একটি সিন্ডিকেট। জামাল উদ্দিন নামে এক অফিস সহকারীর নেতৃত্বে এই সিণ্ডিকেটে রয়েছে বিআরটিএর অন্তত ৩০ কর্মকর্তা-কর্মচারী।

চলতি বছরের ৪ মার্চ থেকে ২০০৩ মডেলের সিএনজি স্ক্র্যাপ করার কাজ শুরু করে বিআরটিএ। এই কাজ শেষ হওয়ার কথা আগামী ৩০ জুন।

জামালের ইশারায় রাত হয় দিন

লেনদেন করতে হয় এই জামালের সঙ্গেই
লেনদেন করতে হয় এই জামালের সঙ্গেই
১৫ বছরের পুরোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশার ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর সঠিক আছে কিনা কিংবা সিএনজিটি স্ক্র্যাপযোগ্য কিনা তা দেখভালের জন্য একজন মোটরযান পরিদর্শককে মনোনীত করার নিয়ম থাকলেও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ তার ধার ধারেনি। মোটরযান পরিদর্শককে দায়িত্ব কিংবা নিয়োগ দেওয়ার বদলে এখানে মনোনীত করা হয়েছে অফিস সহকারী জামাল উদ্দিনকে। মূলত পুরোনো সিএনজি অটোরিকশাকে স্ক্র্যাপ ঘোষণার আওতায় আনতে সিএনজি মালিকদের লেনদেন করতে হয় এই জামালের সঙ্গেই। তার ইঙ্গিতেই স্ক্র্যাপযোগ্য সিএনজি অটোরিকশা কখনও ‘স্ক্র্যাপ অযোগ্য’, আবার কখনও তার ইশারাতেই স্ক্র্যাপ অযোগ্য সিএনজি অটোরিকশা ‘স্ক্র্যাপ যোগ্য’ হয়ে যায়। টাকার চাহিদায় মাত্রা কখনও বেশি হয়ে গেলে অটোরিকশা মালিকদের বিপাকেও পড়তে হচ্ছে। টাকা লেনদেনে কাউকে সন্দেহ হলে কিংবা বিপাকে পড়তে হবে এমন আশঙ্কা দেখা দিলে নোয়াখালী থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় সাংসদ একরামুল করিম তার আপন চাচা কিংবা কখনো আপন মামা বলে ভয় দেখান জামাল উদ্দিন—এমন অভিযোগ একাধিক অটোরিকশা মালিকের। এমনকি সরকারদলীয় এক মন্ত্রীকেও তার নিকটাত্মীয় পরিচয়ে ভয় দেখানো হয়ে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত অফিস সহকারী জামাল উদ্দিনের বাড়ি নোয়াখালী বেগমগঞ্জের কবিরহাট এলাকায়।

পাঁচ বছর ধরে বহাল তবিয়তে
জামাল উদ্দিনের চাকরি ও পদবি নিয়েও রয়েছে নানা প্রতারণা। তিনি নিজেকে একেক সময় পদের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। কখনো তিনি বিআরটিএ রেজিস্ট্রেশন শাখার কর্মকর্তা, আবার কখনো বিআরটিএ কম্পিউটার শাখার কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন সিএনজি অটোরিকশা মালিকদের কাছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামাল উদ্দিন বিআরটিএর অফিস সহকারী পদে কর্মরত রয়েছেন অন্তত পাঁচ বছর ধরে। এক্ষেত্রেও সরকারি বিধির অনিয়ম রয়েছে। তিন বছর পর পর বদলির নিয়ম থাকলেও বিআরটিএ পরিচালক, উপ-পরিচালকসহ একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যের কারণে অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হচ্ছে।

ঘুষ লেনদেন চট্টগ্রামের চার শোরুমে
সিএনজিচালিত অটোরিকশা মালিকদের সঙ্গে ঘুষ লেনদেনেও অবলম্বন করা হচ্ছে বিশেষ সর্তকতা। সরাসরি লেনদেন করা হচ্ছে মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ অটোরিকশার। এসবকে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ ‘তদবির’ হিসেবে দেখছে। কারণ তদবিরের গাড়ি থেকে বেপরোয়া ঘুষ লেনদেন করা যায় না। আর ৯০ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা মালিকদের কাছ থেকে নতুন গাড়ি কেনা এবং রেজিস্ট্রেশন ছাড়া শুধুমাত্র পুরাতন সিএনজি অটোরিকশাকে স্ক্র্যাপযোগ্য করার ঘুষ বিনিময় হয় চট্টগ্রামের চারটি গাড়ির শোরুমে। এসব শোরুমের মালিকদের হাতে তুলে দিতে হয় ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। শোরুম ও তার মালিকরা হচ্ছেন নগরীর হালিশহর ছোটপুল এলাকার উত্তরা মটরস লিমিটেডের ডিলার ইমাম ডেন্ডিং, বাদুরতলা উত্তরা মটরস লিমিটেডের ডিলার জাফর অ্যান্ড কোম্পানি, ডবলমুরিং সুপারিপাড়ায় উত্তরা মটরসের ডিলার রাজামিয়া অ্যান্ড সন্স এবং পাঁচলাইশ বাদুরতলায় উত্তরা মটরসের ডিলার এস বি কপোরেশন।

ক্ষুদে বার্তায় যায় বিশেষ ‘ক্লিয়ারেন্স’
উল্লেখিত চার শোরুমে টাকা লেনদেনের পর সেখান থেকে টাকা আদায়ের সাংকেতিক চিহ্নসম্বলিত ‘ক্লিয়ারেন্স’ পাঠানো হয় বিআরটিএর অফিস সহকারী জামাল উদ্দিনের বিশেষ তিনটি মোবাইল নম্বরে। ক্ষুদে বার্তায় পাঠানো ওই বিশেষ ক্লিয়ারেন্সে গাড়ির নম্বর, চেসিস নম্বর, ইঞ্জিন নম্বরসহ বিভিন্ন বিষয়ে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছেন ঘুষদাতা সিএনজিচালিত অটোরিকশার একাধিক মালিক।

ম্যাজিস্ট্রেটের পাশে সারাক্ষণই মাস্ক মুখে দিয়ে বসা জামাল উদ্দিন
ম্যাজিস্ট্রেটের পাশে সারাক্ষণই মাস্ক মুখে দিয়ে বসা জামাল উদ্দিন

বৃহস্পতিবার (২৩ মে) চট্টগ্রাম বালুছড়া বিআরটিএ কার্যালয়ে সারাদিনের অনুসন্ধানে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। দেখা গেছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানার একটু দূরে সারাক্ষণই মাস্ক মুখে দিয়ে বসে থাকছেন জামাল উদ্দিন। কিছুক্ষণ পর পর তাকে মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা চেক করতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জামাল নিজেকে বিআরটিএ অফিসের কম্পিউটার শাখায় কর্মরত বলে পরিচয় দেন। এসএমএসে টাকা পরিশোধের বিশেষ ‘সিগন্যাল’ আসলেই সিএনজি স্ক্র্যাপ করা হচ্ছে—এমন অভিযোগ অস্বীকার করলেও নিজের মোবাইল পরীক্ষা করতে দিতে অস্বীকৃতি জানান জামাল। বিষয়টি নিকটে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানাকে জানানো হলে তিনি উল্টো জামালের পক্ষ নেন।

বাকলিয়া থেকে নিজের সিএনজিচালিত অটোরিকশা জমা দিতে এসেছিলেন কোরবান আলী (৫০)। কিন্তু চেসিস নম্বর বোঝা যাচ্ছে না—এমন অজুহাতে জমা নেওয়া হয়নি গাড়িটি। তাকে এই প্রতিবেদক জিজ্ঞেস করেন, ‘কন্ট্রাক্ট করেছেন কিনা?’ কোরবান আলী ‘না’ বোধক উত্তর দেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!