বর্ষা ভয়ংকর/ এক যুগে পাহাড়ধসে মাটিচাপা ৩৭৪ জনের স্বপ্ন!

২০০৭ সালের ১১ জুন হাটহাজারীর তিনটি পরিবারের স্বপ্ন চার মিটার মাটির নিচে চাপা পড়ে। সেই মৃত্যুর মিছিল গিয়ে শেষ হয় গণকবরে। শেষে ১২৭ জন মানুষের মাটিচাপা পড়া দেহ উদ্ধার করা হয়। সেই সঙ্গে চাপা পড়ে তাদের লালিত স্বপ্ন!

প্রবল বর্ষণের ফলে পাহাড় থেকে মাটি ও কাদার ঢল পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বস্তি ও কাঁচা ঘরবাড়ির ওপর ধসে পড়লে বহু মানুষ চাপা পড়ে। অনেক মানুষ নিখোঁজ হয়। উদ্ধারকর্মীরা দিনভর তৎপরতা চালিয়ে যায় এবং মৃত ও আহতের সংখ্যা বেড়েই চলে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয় হাটহাজারী। আবহাওয়াবিদদের মতে, সেদিন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রামে ২০ সেন্টিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়। ১২ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৩৯৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। ১১ জুন থেকে চলা টানা বর্ষণ ছিল এই ট্রাজেডির মূল কারণ। বিশেষজ্ঞের মতে, এটি চট্টগ্রামের ইতিহাসে ভয়াবহতম ভূমিধ্স। চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ যা শহরের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ, তিন থেকে চার ফুট পানিতে আটকা পড়ে।

chittagong-hill-slide-kill
বস্তি ও কাঁচা ঘরবাড়ির ওপর পাহাড় ধসে পড়লে বহু মানুষ চাপা পড়ে।

সেই ভয়াবহ পাহাড়ধসের এক যুগ পূর্ণ হলো মঙ্গলবার (১১ জুন)। ২০০৭ সালের এই দিনে ওই দুর্ঘটনায় ১২৭ জন মারা যান। এরপর ঘটেছে পাহাড় ধসের আরও ঘটনা। গত এক যুগে চট্টগ্রামের পাহাড় ধসে প্রাণ গেছে অন্তত ৩৭৪ জনের। সর্বশেষ গত বছরের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের আকবরশাহের ফিরোজশাহ কলোনিতে মা মেয়েসহ চারজন নিহত হন পাহাড় ধসের কারণে।

পাহাড়ধসে মৃত্যুর ধারাপাত
২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের সাতটি স্থানে মাটিচাপায় ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখানবাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে ২ জন মারা যায়। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড়ধসে তিনজন এবং ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে মা-মেয়ে মারা যায়। ২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় প্রাণ হারায় ১৫৮ জন। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের আকবরশাহের ফিরোজশাহ কলোনিতে ৪ জন মারা যায়।

chittagong-hill-slide-kill
ঝুঁকিপূর্ণ ১৭ পাহাড় অবৈধ দখলমুক্ত হচ্ছেই না

বর্ষা এলেই পাহাড়ধস
বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এজন্য প্রতিবছরই বর্ষার আগে পাহাড়ে ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় তা বাস্তবায়ন হয় না। ঝুঁকিপূর্ণ ১৭ পাহাড় মালিকদের এক মাসের মধ্যে অবৈধ দখলমুক্ত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রশাসন। সেই নির্দেশনা ৪৫ দিনেও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

১৭ ঝুঁকিপূর্ণ এসব পাহাড়ের মধ্যে ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং বাকি সাতটির মালিক সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, গণপূর্ত ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ।

সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন চট্টগ্রাম মহানগরীর এসব পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে। প্রশাসনের নির্দেশে বিভিন্ন সময় নগরীর লালখানবাজার মতিঝর্ণা, পোড়া কলোনি, উত্তর পাহাড়তলীর লেকভিউ আবাসিক এলাকা এবং আমবাগান এলাকার এ কে খানের পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৩০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। অভিযানে ওইসব এলাকার ৪১টি বিদ্যুতের অবৈধ মিটার ও একটি ট্রান্সফরমার বিচ্ছিন্ন করা হয়। একটি অবৈধ ট্রান্সফরমার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বিচ্ছিন্ন না করে ফিরে আসতে হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতকে। এছাড়া ওইসব এলাকা থেকে অবৈধভাবে নেওয়া গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। বর্ষা মৌসুম আসন্ন হলেও রোজার কারণে মানবিক দিক বিবেচনায় উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রম পিছিয়ে গেছে বলে প্রশাসনের দাবি।

ঢিমেতালে উচ্ছেদ অভিযান
গত ১৬ এপ্রিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৯তম সভায় পরবর্তী একমাসের মধ্যে প্রশাসনের করা তালিকা অনুযায়ী ১৭ পাহাড়ের ৮৩৫ পরিবারকে উচ্ছেদ করে পাহাড় খালি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিভাগীয় কমিশনার। ওই সভাতেই পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে পাহাড়গুলোর ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে থাকা অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থার দেওয়া সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।

উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিককে প্রধান করে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। সে অনুযায়ী গত ২ মে নগরীর লেকভিউ আবাসিকের ঝিলপাড় এলাকা থেকে অভিযান শুরু করে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা। সেখানে আটটি বিদ্যুতের মিটার ও একটি ট্রান্সফরমার বিচ্ছিন্ন করা হয়। অভিযানের পর দিন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা ট্রান্সফরমার খুলে আনতে গেলে তাদের ওপর প্রভাবশালীরা হামলা চালায়

গত ৪ মে মতিঝর্ণা এলাকায় অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করা হয় প্রায় ২০০ পরিবারকে, বিচ্ছিন্ন করা হয় ২৪টি বৈদ্যুতিক মিটার। সেখানে অবৈধভাবে থাকা একটি ট্রান্সফরমার বিচ্ছিন্ন করতে গেলে লালখানবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহিলাদলনেত্রী মনোয়ারা বেগম মনির বাধার কারণে তা করা যায়নি।

গত ৫ মে লালখান বাজার পোড়া কলোনি এলাকার পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে ৭০ পরিবার উচ্ছেদ এবং সাতটি মিটার জব্দ করা হয়। ৯ মে আমবাগান এলাকার একে খান পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে ৭০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়, বৈদ্যুতিক মিটার বিচ্ছিন্ন করা হয় সাতটির মতো।

এরপর এখন পর্যন্ত প্রশাসনের উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের বাকি পরিবার উচ্ছেদে কোন অভিযান চালানো হয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিলাম কিন্তু রোজার কারণে অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষা শুরুর আগে কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা সভা করে পুনরায় উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করব।’

প্রতিবারই বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা করে সেখানে বসতি স্থাপনকারী পরিবার চিহ্নিত করে তাদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয় না, ঠেকানো যায় না পাহাড় ও ভূমিধসে প্রাণহানি।

সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়গুলোতে অভিযান পরিচালনাকারী চট্টগ্রামের কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তৌহিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এতগুলো পরিবারের মাঝে ২২টি পরিবার খুব ঝুঁকিতে রয়েছে। অভিযানে আমরা শুধু পরিবারই উচ্ছেদ করছি না, সেখানে দেওয়া পানি-বিদ্যুতের সকল অবৈধ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করছি।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘দেখা যায় অনেক সময় বাধা আসে। তারপরেও আমাদের অভিযান থামেনি। বাকি ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরাতে আমরা দ্রুতই অভিযানে যাব।’

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘রোজার কারণে অভিযান সাময়িক বন্ধ ছিল। দ্রুতই বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাস করা ৪৮৫ পরিবারকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। তাছাড়া এবার পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারীদের পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করা হয়েছে। এরপরও পাহাড় ধসে যদি মৃত্যু হয়, তাহলে মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোয়াজ্জম হোসাইন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাহাড় কাটা বন্ধে নিয়মিত আমরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। রোজার কারণে অভিযান কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ ছিল। দ্রুতই আমরা ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে বাকি বসতি উচ্ছেদের কাজ শুরু করব।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!